প্যালেস্টাইন তথা গাজার উপরে ইজরায়েলের আগ্রাসনের প্রতিবাদে সাম্প্রতিক সময়ে বাকি বিশ্বের পাশাপাশি জাপানের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক বার বিক্ষোভে সামিল হতে দেখা গেছে সে দেশের সাধারণ মানুষদের। আর এই সার্বিক পরিস্থিতির মধ্যে সম্প্রতি সামাজাকি যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয়েছে এই সংক্রান্ত দুটি ভিডিও। যেখানে প্রথম ভিডিওতে কোনও একটি রাজপথে হাতে প্যালেস্টাইনের পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন হাজার-হাজার মানুষ। অন্যদিকে দ্বিতীয় ভিডিওতে কোনও শহরের একটি বিখ্যাত রাস্তার উপরে কয়েক লক্ষ্য মানুষকে প্যালেস্টাইনের পতাকা নিয়ে ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ স্লোগান দিতে এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে দেখা যাচ্ছে।
দুটি ভিডিওই শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে, গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে এবং প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার দাবিতে জাপানে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলে সামিল হয়েছে দেশটির হাজার-হাজার নাগরিক। উদাহরণস্বরূপ, প্রথম ভিডিওটি শেয়ার করে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন,“গাঁ*জা'য় গনহ"ত্যা'র প্রতিবাদে জাপানে হাজারো মানুষের বি*ক্ষোভ।”
অন্যদিকে অপর এক ফেসবুক ব্যবহারকারী দ্বিতীয় ভিডিওটি শেয়ার করে লিখেছেন, “ জাপানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব চলছে ইজরায়েল বিরোধী সমাবেশ এবং প্যালেস্টাইন কে মুক্তি সমাবেশ।” (সব বানান অপরিবর্তিত)
ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, যদিও এটা ঠিক যে, সাম্প্রতিক সময়ে গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে এবং প্যালেস্টাইনের সমর্থনে জাপানে একাধিক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে ভাইরাল ভিডিও দুটি সেই সব বিক্ষোভের নয়। বরং দুটি ভিডিওই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি।
সত্য উন্মোচন হলো যেভাবে
প্রথম ভিডিও: ভিডিওটি সন্দেহজনক। কারণ সেটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার সময় সেখানে উপস্থিত বিক্ষোভকারীদের অঙ্গভঙ্গিতে একাধিক অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়। কারণ আমরা লক্ষ্য করি বিক্ষোভকারীদের অনেকের হাত নেই। এমনকি তাদের মধ্যে অনেকের হাত হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যেতেও দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে ভিডিওতে দূর থেকে যাদেরকে প্যালেস্টাইনের পতাকা ধরে থাকতে দেখা যাচ্ছে, ক্যামেরা কাছে নিয়ে গেলে দেখা যাচ্ছে আদতে তারা পতাকাটি ধরে নেই। এমনকি যারা পতাকা ধরে রয়েছে ভালো করে লক্ষ্য দেখা যায় পতাকার লাঠি তাদের হাতে নয় বরং তা যেন শূন্যে ভাসছে।
উপরের উল্লেখিত বিষয়গুলি থেকে সন্দেহ তৈরি হয় যে ভিডিওটি আসল নয় বরং সেটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি হলেও হতে পার। তবে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়, যখন আমরা ভিডিওর ডান পাশের একদম নীচের দিকের ফ্রেমের উপরে “Veo” লেখা একটি ওয়াটার মার্ক দেখতে পাই। যা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে ভিডিওটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি। কারণ “Veo” বা “Google Veo” হলো গুগলের তরফে তৈরি একটি শক্তিশালী এআই মডেল। যা টেক্সট বা ইমেজ প্রম্পট থেকে বাস্তবসম্মত ভিডিও তৈরি করতে সক্ষম। অর্থাৎ কোনও গ্রাহক যদি কোনও নির্দিষ্ট ঘটনার ভিডিও বানানোর জন্য যদি “Google Veo”কে লিখে দেয়, “Google Veo” সেই লেখা বা টেক্সট অনুযায়ী সেই ঘটনার হুবহু ভিডিও বানিয়ে দেব। যে ভিডিও দেখতে বাস্তব মনে হলেও তার সঙ্গে বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই।
এরপর বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে ভাইরাল ভিডিওটিকে Cantilux নামক এআই যাচাইকারী ওয়েবসাইটে পরীক্ষা করা হয়। ওয়েবসাইটি ৭১ শতাংশ নিশ্চিতভাবে জানিয়েছে যে ভাইরাল ভিডিওটি এআই-এর সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে।
দ্বিতীয় ভিডিও: দ্বিতীয় ভিডিওটির সত্যতা জানতে সেটি থেকে একাধিক কিফ্রেম নিয়ে গুগলে রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে ২০২৫ সালের ৩১ জুলাই syedawiali নামক একটি টিকটক হ্যান্ডেলে এই একই ভিডিওর সব থেকে পুরনো ইন্টারনেট সংস্করণটি পাওয়া যায়। ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করার সময় সেটির কমেন্ট সেকশনে একাধিক ব্যক্তি ভিডিওটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি বলে উল্লেখ করেছেন। এমনকি ওই টিকটক হ্যান্ডেলে এই ধরণের আরও একাধিক ভিক্ষোভের ভিডিও-ও পাওয়া যায়। সেইসব ভিডিওর কমেন্ট সেকশনে সেগুলি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি বলে উল্লেখ করেছেন টিকটক ব্যবহারকারী।
এরপর উক্ত তথ্যের উপরে ভিত্তি করে ভিডিওটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এই ভিডিওতেও একাধিক অসঙ্গতি রয়েছে। যেমন, ভিডিওর বাম পাশের নীচের কোণে মিছিলে অংশগ্রহণকারী বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অনেককেই একে অপরের সঙ্গে মিশে বা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। যা থেকে অনুমান করা যায় যে ভিডিওটি আসল নয় বরং সেটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি হলেও হতে পার। এরপর বিষয়টি সম্পর্কে জানতে আমরা ভিডিওটি নিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই বিশেষজ্ঞ সংস্থা ডিপফেকস অ্যানালাইসিস ইউনিট বা DAU-এর সঙ্গে যোগাযোগ করি। ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করার পর DAU-এর তরফে সেটিতে একাধিক অসঙ্গতি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ভিডিওটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
এরপর বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে আমরা দ্বিতীয় ভিডিওটি নিয়েও Cantilux নামক এআই যাচাইকারী ওয়েবসাইটে পরীক্ষা করি। ওয়েবসাইটি ৬৬ শতাংশ নিশ্চিতভাবে জানিয়েছে যে ভাইরাল ভিডিওটি এআই-এর সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে।
এর থেকে প্রমাণ হয় যে, গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে জাপানে বিক্ষোভ দাবি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি ভিডিও।
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে এবং প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার দাবিতে জাপানে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে দেশটির হাজার-হাজার নাগরিক।
যদিও এটা ঠিক যে, সাম্প্রতিক সময়ে গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে জাপানে একাধিক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে ভাইরাল ভিডিও দুটি সেই সব বিক্ষোভের নয়। বরং দুটি ভিডিওই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি।