সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও বেশ ভাইরাল হয়েছে। যেখানে কোনওটি বাড়ি বা অফিসের ভিতরে দু’জন ব্যক্তি একজনের চার হাত-পা ধরে শূন্যের উপরে উল্টোভাবে ঝুলিয়ে রেখেছেন। আর অন্য দু’জনকে তাকে লাঠি বা উইকেট জাতীয় কিছু দিয়ে বেধড়কভাবে মারতে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন আরও বেশ কয়েকজন। ভিডিওটি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে, একজন মহিলার উপরে মুসলিমরা নির্মমভাবে অত্যাচার করছে।
উদাহরণস্বরূপ, এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ভাইরাল ভিডিওটি শেয়ার করে লিখেছেন, “নারীটি শূন্যে ঝুলছে৷ নারীটি সনাতনী নাকি অন্য ধর্মের এই সংবাদ এখনও জানা যায়নি। তাই বলে একজন সনাতনী পুরুষ হিসেবে চুপ করে থাকা অন্যায় হবে। নারীদের উপর অত্যাচার হলে এর প্রতিবাদ এবং প্রতিশোধ উভয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কারণ মহাভারত আমাদের এই শিক্ষাই দেয়। এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দুইজন পুরুষ টেনে ধরে আছে দুই হাত, দুই পা টেনে ধরে আছে অন্য দুজন। অপর দুই পাশ থেকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে দুইজন পুরুষ। প্রত্যেকেই কাপুরুষ মানুষ। দুঃখিত কাপুরুষ মুসলিম।” (সব বানান অপরিবর্তিত।)
ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ভাইরাল ভিডিওটি কামারহাটির আড়়িয়াদহের তালতলার ক্লাবের এবং এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত জয়ন্ত সিং-সহ মোট ৮ জন অপরাধীর কেউই মুসলিম নয় বরং হিন্দু।
কীভাবে জানা গেল সত্য?
ভাইরাল দাবি ও ভিডিওটি সম্পর্কে জানতে সেটির কি-ফ্রেম সার্চ করলে ২০২৪ সালের ৮ জুলাই পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির অফিশিয়াল এক্স হ্যন্ডেলে এই একই ভিডিও পাওয়া যায়। ভিডিওটি শেয়ার করে সেখানে সেটিকে কামারহাটির তালতলা ক্লাবের দৃশ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি এই ঘটনার সঙ্গে তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্র ঘনিষ্ঠ জয়ন্ত সিং জড়িত বলেও সেখানে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির অফিশিয়াল এক্স হ্যন্ডেলে কোথাও অভিযুক্তদের মুসলিম বলে উল্লেখ করা হয়নি।
এরপর এই সূত্রধরে পরবর্তী সার্চ করলে ২০২৪ সালের ১০ জুলাই আনন্দবাজার অনলাইনে ভাইরাল ভিডিওর স্ক্রিনশট-সহ এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। সেখানে উল্লেখ হয়েছে, “কামারহাটির ভিডিয়োকাণ্ডে এখনও পর্যন্ত জয়ন্ত সিংহের ছয় সঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার অলোক রাজোরিয়া জানিয়েছেন, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে আড়িয়াদহের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রাহুল গুপ্ত নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে মোবাইল ফোন চুরির ঘটনা ঘটে। কিন্তু তিনি থানায় কোনও অভিযোগ দায়ের করেননি। চুরির ঘটনায় এক দম্পতির দিকে সন্দেহ হয় স্থানীয়দের একাংশের। কামারহাটির আড়িয়াদহ তালতলা স্পোর্টিং ক্লাবে ওই দু’জনকে নিয়ে এসে বেধড়ক মারধর করা হয়।”
এরপর ২০২৪ সালের ৯ জুলাই ব্যারাকপুর পুলিশের অফিশিয়াল এক্স হ্যান্ডেলে ভাইরাল ভিডিওটি নিয়ে একটি পোস্ট পাওয়া যায়। সেখানে ভিডিওটিকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে কামারহাটির আড়িয়াদহ তালতলা স্পোর্টিং ক্লাবের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি এই ঘটনায় মোট ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও সেই টুইটে জানানো হয়েছে।
২০২৪ সালের ১০ জুলাই সংবাদ প্রতিদিনের অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে ভাইরাল ভিডিওটি নিয়ে ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার অলোক রাজোরিয়ার একটি সাংবাদিক সম্মেলন পাওয়া যায়। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, “ভিডিওটি প্রকাশ্যে আসতেই আমরা বেলঘড়িয়া থানায় ৮ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করি। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে এখনও পর্যন্ত ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।”
তাই এরপর ভাইরাল ভিডিওর অভিযুক্তরা মুসলিম কিনা সে বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আমরা বেলঘড়িয়া থানা অফিসার ইনচার্জ শুভ্রাজিৎ মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের জানান, “ভিডিওটি সামনে আসতেই এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আমরা প্রথমে ৬ জনকে গ্রেফতার করি। পরবর্তীতে আরও দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের নাম হল: ১) জয়ন্ত সিং, ২) অভিষেক বর্মন, ৩) সুমন দে, ৪) সুভাষ বেরা, ৫) সৈকত মান্না ওরফে জঙ্গা, ৬) সন্দীপ সাহা, ৭) প্রসেনজিৎ দাস ওরফে লাল্টু এবং ৮) রাহুল গুপ্তা। এবং এদের কেউই মুসলিম নয় বরং হিন্দু।”
এর থেকে প্রমাণ হয় যে কামারহাটির তালতলার ক্লাবে তৃণমূল ঘনিষ্ঠ জয়ন্ত সিং ও তার অনুগামীদের ভিডিও মিথ্যে সাম্প্রদায়িক রং লাগিয়ে শেয়ার করা হচ্ছে।
ভিডিওটিতে মুসলিম বা ইসলামপন্থীদের তরফে একজন মহিলার উপরে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে।
পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই ভিডিওটি ২০২১ সালের এবং এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত জয়ন্ত সিং-সহ মোট ৮ জন অপরাধীর কেউই মুসলিম নয় বরং হিন্দু।