সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ ভাইরাল হয়েছে দুটি ক্লিপের একটি ভিডিও। যেখানে প্রথম ক্লিপে বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে একজের দুই হাত বেঁধে জোরপূর্বক তার মাথা ন্যাড়া করে দিতে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় ক্লিপে অক্রান্ত ব্যক্তিকে সংবাদমাধ্যমের সামনে বলতে শোনা যাচ্ছে যে, তিনি শ্রামিকের কাজ করতে অস্বীকার করায় তার সঙ্গে এই আচারণ করা হয়েছে।
ভিডিওটি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে, গত ৩০ জুন হুল দিবসের দিন বিজেপি শাসাতি উত্তরপ্রদেশে উচ্চবর্ণের মানুষরা একজন নিম্নবর্ণ বা আদিবাসী ব্যক্তির উপরে অমানবিক অত্যচার চালিয়ে জোর করে তার মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছে। (এখানে উল্লেখ্য ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন ইংরেজদের বিরুদ্ধে সূচনা হয়েছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ। পরবর্তীতে ৩০ জুন দিনটি হুল দিবস হিসাবে পালন করা হয়। যেখানে 'হুল' শব্দের অর্থ হলো 'বিদ্রোহ'।)
উদাহরণস্বরূপ, এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ভাইরল ভিডিওটি শেয়ার করে লিখেছেন, আজ "হুল দিবস" – এক গৌরবময় ঐতিহাসিক দিনে আমরা যখন গর্বিত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাওতাল নেতা সিধু-কানু ও আদিবাসি ভাই বোনেদের আত্মত্যাগ নিয়ে ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশে চলছে আদিবাসি ভাইদের উপর অ.মানবিক অ.ত্যচার! এটাই কি মোদিজির নতুন ভারতের নিদর্শন ? এটাই কি যোগীজির উত্তরপ্রদেশ মডেল ?” (সব বানান অপরিবর্তিত)
ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, ভাইরাল ভিডিওটি গত ৩০ জুন, হুল দিবসের দিনের নয়। বরং সেটি ২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবর উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসি জেলার সিপ্রি বাজার থানার টাকোরি গ্রামের ঘটনা। পাশাপাশি এর সঙ্গে জাতিগত বৈষম্যের কোনও সম্পর্ক নেই; এখানে আক্রান্ত এবং অভিযুক্ত সকলেই একই জাতির মানুষ।
সত্য উন্মোচন হলো যেভাবে
ভাইরাল দাবি ও ভিডিওটির সত্যতা জানতে সেটি থেকে একাধিক কিফ্রেম নিয়ে গুগলে রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে ২০২৪ সালের ২৫ অক্টোবর কংগ্রেসের অফিশিয়াল এক্স হ্যান্ডেলে এই একই ভিডিও-সহ একটি পোস্ট পাওয়া যায়। ভিডিওর ক্যাপশন থেকে জানা যা যে সেটি উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসি জেলার ঘটনা। এর থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে ভাইরাল ভিডিওটি গত ৩০ জুন, হুল দিবসের দিনের নয়। বরং সেটি তার আগের ঘটনা।
এরপর কংগ্রেসের অফিশিয়াল এক্স হ্যান্ডেলে প্রাপ্ত ভিডিওটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার সময় আমরা এর কমেন্ট সেকশনে ঝাঁসি পুলিশের অফিশিয়াল এক্স হ্যান্ডেল থেকে একটি পোস্ট দেখতে পাই। ঝাঁসি পুলিশের সেই পোস্ট অনুযায়ী, ভাইরাল ভিডিওটি ২০২৪ সালের ২২ অক্টোবর উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসি জেলার সিপ্রি বাজার থানা এলাকার ঘটনা। ভিডিওর অক্রান্ত ব্যক্তির নাম বাবা। তিনি ২৩ অক্টোবর সিপ্রি বাজার থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করে জানিয়েছেন, তার সম্প্রদায়ের ৪ ব্যক্তি কোনও কারণ ছাড়াই তাকে গালিগালাজ, মারধর করার পাশাপাশি হত্যার হুমকি দিয়েছে। পুলিশ ঘটনার ভিডিও পর্যবেক্ষণ করে ৪ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে একটি এফআইআর দায়ের করে বিষয়টির তদন্ত শুরু করেছে এবং অভিযুক্তদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছে।
এরপর উক্ত তথ্যের উপরে ভিত্তি করে পরবর্তী অনুসন্ধান চালালে একাধিক সংবাদমাধ্যমে এই সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়। সেই সব প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালের ২২ অক্টোবর সিপ্রি বাজার থানার পাদ্রি গ্রামের বাসিন্দা বাবা কবুতর নামক এক ব্যক্তি পাশ্ববর্তী টাকোরি গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পশুখাদ্য এবং পশুর বর্জ্য পরিষ্কার করার জন্য শ্রমিকের কাজ করতে অস্বীকার করে। তখন টাকোরি গ্রামের প্রভাবশালী চার ব্যক্তি বাবা কবুতরকে অপহরণ করে তাদের গ্রামে নিয়ে যায় এবং সেখানে তারা বাবা কবুতরকে মারধরের পাশাপাশি তার মাথা ন্যাড়া করে দেয়।
এরপর ২০২৪ সালের ২৬ অক্টোবর ঝাঁসি পুলিশের অফিশিয়াল এক্স হ্যান্ডেলে এই সংক্রান্ত একটি পোস্ট পাওয়া যায়। সেই পোস্টে ঝাঁসির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জ্ঞানেন্দ্র কুমার সিং একটি ভিডিও বিবৃতিতে জানিয়েছেন, বাবা কবুতরকে মারধরের অভিযোগে তারই সম্প্রদায় বা জাতির তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাশাপাশি ওই পোস্টে গ্রেফতার তিন অভিযুক্তের লকআপে দাঁড়িয়ে থাকার একটি ছবিও শেয়ার করা হয়েছে। যাদের ভাইরাল ভিডিওতে দেখা গেছে।
তবে সম্প্রতি ফের একবার এই ঘটনার ভিডিওটি জাতিগত রং গালিয়ে ভাইরাল হওয়ার পর ঝাঁসি পুলিশের অফিশিয়াল এক্স হ্যান্ডেল থেকে পুনরায় একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। চলতি বছরের ১ জুলাই একটি এক্স হ্যান্ডেল থেকে এই একই ভিডিও একই দাবি-সহ শেয়ার করা হলে আমরা তার কমেন্ট সেকশনে ঝাঁসি পুলিশের টুইট দেখতে পাই। সেখানে পুলিশের তরফে ভিডিওটি ৮ মাস পুরনো বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি জানানো হয়েছে, এই ঘটনায় আক্রান্ত এবং অভিযুক্ত সকলেই একই জাতির মানুষ। এবং ভিডিওটি নিয়ে যারা জাতিগত বৈষম্যের রং লাগানোর চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর বিষয়টি নিয়ে আমরা সিপ্রি বাজার থানার এসএইচও আনান্দ কুমার সিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনিও আমাদের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন যে, ভাইরাল ভিডিওর সঙ্গে জাতিগত বৈষম্যের কোনও সম্পর্ক নেই। এখানে আক্রান্ত এবং অভিযুক্ত সকলেই একই সম্প্রদায়ের মানুষ।
এর থেকে প্রমাণ হয় যে, উত্তরপ্রদেশে একই সম্প্রদায়ের মানুষের দ্বারা অক্রান্ত হওয়া এক ব্যক্তির ভিডিও মিথ্যে জাতিগত বৈষম্যের রং দিয়ে শেয়ার করা হচ্ছে।
ভিডিওতে গত ৩০ জুন, হুল দিবসের দিন উত্তরপ্রদেশে উচ্চবর্ণের মানুষেরা একজন আদিবাসী ব্যক্তিকে মারধর করার পর তার মাথা ন্যাড়া করে দিতে দেখা যাচ্ছে।
ভিডিওটি গত ৩০ জুনের নয় বরং সেটি ২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবরের ঘটনা। পাশাপাশি এর সঙ্গে জাতিগত বৈষম্যের কোনও সম্পর্ক নেই; এখানে আক্রান্ত এবং অভিযুক্ত সকলেই একই জাতির মানুষ।