সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখে আঘাতের দাগ-সহ একটি মেয়ের ছবি বেশ ভাইরাল হয়েছে। ছবিটি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে যে এই হিন্দু মেয়েটি একটি মুসলিম ছেলের সঙ্গে বিয়ে করেছিল এবং তারপর এই পরিণতি হয়েছে।
এই দাবি-সহ যে ছবিটি শেয়ার করা হয়েছে সেখানে মেয়েটির দুই চোখে ও চোখের নীচে রক্ত জমাট বাঁধা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। ছবিটি শেয়ার করে ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, "আমার আব্দুলটা একেবারে 'বিশেষ', প্রেম ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না" — আর সেই কারণেই আজ এই পরিণতি। লাভ জিহাদের ফাঁদে পড়ে আরেকটা মেয়ে প্রেমের মায়াজালে জড়িয়ে, পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। বিয়ের এক বছরও পেরোয়নি, তখনই শুরু হয় আব্দুলের আসল খেলা — মারধর, অত্যাচার, নাচন-কোদন আর মানসিক পীড়ন। একসময় যে মেয়ের মুখ ছিল টসটসে আপেলের মতো, সেই মুখই আজ চ্যাপ্টা হয়ে ভাঙারি টিনের মতো পিটপিটে — দেখে চিনতে কষ্ট হয়!এই মেয়েটা হয়তো নিজের কৃতকর্মের যোগ্য শাস্তি পেয়েছে — এমনটাই হওয়া উচিত এইসব অন্ধপ্রেমীদের। টুকরা হয়ে বস্তাবন্দি হওয়ার আগেই পালিয়ে গিয়ে ঠাঁই নেয় তার মায়ের কাছে, কিন্তু মা-বাবা নিজের মেয়ের এই নোংরা মুখোশ দেখে ঝেটিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়।এখন মেয়েটি পুলিশের হেফাজতে রয়েছে, আর আব্দুলকেও গ্রেফতার করেছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ।”
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সোশ্যাল মিডিয়ায় মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কটুক্তি করতে এই ধরনের ‘আব্দুল’ নাম ব্যবহার করে থাকে চরমপন্থীরা।
আজতক ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে এটি কোনও আসল ঘটনা নয় বরং একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটর একটি ফিল্টার ব্যবহার করে এই ছবি নিজের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে আপলোড করেছিলেন।
সত্য উন্মোচন হলো যেভাবে
ভাইরাল ছবিটিকে গুগল লেন্সের মাধ্যমে খোঁজা হলে ওই একই ছবি আমরা দেখতে পাই শ্বেতা পুন্ডির নামে একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের ফেসবুক প্রোফাইলে। তিনি চলতি বছর ১ অগস্ট ওই ছবিটি আপলোড করেছিলেন।
এরপর শ্বেতা পুন্ডিরের ফেসবুক প্রোফাইল খতিয়ে দেখা হলে নজরে আসে, তিনি ওই একই পোশাক পরে ২ অগস্ট আরও কিছু ছবি একসঙ্গে আপলোড করেছিলেন। তবে সেখানে তাঁর মুখে কোনও ক্ষতচিহ্ন ছিল না। যা থেকে মোটামুটি আন্দাজ করা যায় যে ভাইরাল ছবিতে হয় মেকআপ অথবা কোনও ডিজিটার আর্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে।
শ্বেতা পুন্ডিরের প্রোফাইলটি আরও খতিয়ে দেখা হলে আমাদের আন্দাজ প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। কেননা, গত ৪ অগস্ট তিনি একই ধরনের ক্ষতের দাগ-সহ একটি ছবি ‘গুড নাইট’ ক্যাপশন দিয়ে আপলোড করেছিলেন।
কিন্তু একই দিনে তিনি একই পোশাকে অন্য একটি রিল আপলোড করেছিলেন যেখানে কোনও ক্ষতের চিহ্ন দেখা যায়নি। আবার ২ অগস্ট আপলোড হওয়া আরেকটি রিলে ওই ধরনের ক্ষত দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই মাঝে তিনি অনেকগুলো ছবি ও পোস্ট করেছেন, সেখানে কোথাও এই ক্ষত দেখা যায়নি। ফলে মুখে আঘাতের দাগগুলো যে আসল নয় সেই সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিত হওয়া যায়।
এই বিষয়ে সবিস্তারে জানতে চেয়ে শ্বেতাকে মেসেজ করা হলে তিনি জবাবে জানান যে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম স্ন্যাপচ্যাটের একটি লেন্স বা ফিল্টার ব্যবহার করে তিনি এই ধরনের ছবি বা ভিডিও তৈরি করেছেন। যেমন দাবি সোশ্যাল মিডিয়ায় করা হয়েছে তার সঙ্গে বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই। ফিল্টারটির পোশাকি নাম ‘mmmooort9’ এবং রুমিম তাবুক নামে এক ব্যবহারকারী এই ফিল্টারটি তৈরি করেছেন।
আমরা পরীক্ষা করে দেখি যে এই লেন্স ব্যবহার করে ক্যামেরা অন করলেই মোবাইল ব্যবহারকারীর মুখে এমন এফেক্ট তৈরি হচ্ছে যাতে মনে হবে তার মুখে গভীর কোনও আঘাত লেগে ক্ষত তৈরি হয়েছে। এই লেন্স ব্যবহার করে স্ন্যাপচাটে ছবি আপলোড করেছেন এমন কিছু নমুনা নীচে তুলে ধরা হলো।
ফলে সব মিলিয়ে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে ভাইরাল ছবিটি একটি সম্পূর্ণ মনগড়া এবং সাম্প্রদায়িক দাবিতে শেয়ার করা হয়েছে, যা ভিত্তিহীন।
ছবিতে একটি হিন্দু মেয়েকে দেখা যাচ্ছে যে মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করেছিল এবং বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মেয়েটিকে এভাবে অত্যাচার করা হয়েছে।
গল্পটি সম্পূর্ণ মনগড়া ও ভিত্তিহীন। শ্বেতা পুন্ডির নামে এক কন্টেন্ট ক্রিয়েটর স্ন্যাপচ্যাট ফিল্টারের সাহায্যে এই ধরনের ছবি ও ভিডিও বানিয়ে পোস্ট করেছিলেন।