প্যারিসে বসেছে অলিম্পিকের আসর। আর একসময় এই অলিম্পিকেই অংশ নিতে দেখা যাতে ভারতীয় ফুটবল দলকেও। সেই নিয়েই এবার একটি পোস্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ ভাইরাল হয়েছে। সেই পোস্টে দাবি করা হচ্ছে যে, ১৯৪৮-এর অলিম্পিকে নাকি অর্থাভাবের কারণে ভারতীয় ফুটবলাররা বুটজুতো পরে খেলতে পারেননি।
ভারত বনাম ফ্রান্সের ম্যাচের একটি ছবি শেয়ার করে সেখানে ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, "নিচের ছবিটি ১৯৪৮ সালে #লন্ডন_অলিম্পিকে খেলা ভারতীয় ফুটবল দলের। স্বাধীন ভারতের ফুটবল টীমের কাছে জুতো কেনার পয়সা ছিল না। কিছু খেলোয়াড় মোজা পরে আর বাকিরা খালি পায়ে খেলেছিলেন। এইটা সেই সময় ছিল যখন নেহেরুর দৈনিক পরিধান প্যারিস থেকে ড্রাই ক্লিন হয়ে আসতো। নেহেরুর প্রেমিকা এডবিনাকে লেখা চিঠি এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে করে যেতো।"
পাশাপাশি ওই পোস্টে আরও নানা ধরনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে ১৯৫০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে ভারত না খেলতে যাওয়ার কথা এবং তার কিছু কারণ বিশদে লেখা হয়েছে।
তবে ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, বাকি তথ্যগুলি কমবেশি সঠিক হলেও অর্থের অভাবে ফুটবলাররা খালি পায়ে খেলেছিলেন এই তথ্যটি সঠিক নয়।
কীভাবে জানা গেল সত্যি
সবার প্রথম আমরা খোঁজার চেষ্টা করি ভাইরাল ছবিটির উৎস কী। তখন আমরা ভারতীয় ফুটবল দলের অফিশিয়াল এক্স হ্য়ান্ডেল থেকে করা একটি পোস্ট দেখতে পাই। সেখানে ১৯৪৮-এর অলিম্পিকে ভারতের অংশ নেওয়ার দুটি ছবি পোস্ট করা হয়। একটি ছবিতে ভারতীয় খেলোয়াড়দের মাঠে নামতে, অপর ছবিতে অলিম্পিকের প্রথম ম্যাচ শুরুর আগে ফ্রান্সের অধিনায়কের সঙ্গে করমর্দন করতে দেখা যায়।
২০২১ সালের ৩১ জুলাই পোস্ট করা এই ছবিতে ভারত ও ফ্রান্স উভয় দলের খেলোয়াড়দের সাদা প্যান্ট পরে থাকতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ভাইরাল ছবিতে দেখা গেছে, খেলোয়াড়েরা কালো প্যান্ট পরে। অর্থাৎ, সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ছবিটি পোস্ট করা হয়েছে তা আসলে ১৯৪৮-সালের অলিম্পিকে ভারতের প্রথম ম্যাচ নয়।
আরও কিছু সার্চ করে শেষ পর্যন্ত আমরা ইউটিউবে একটি ১ মিনিটের ভিডিও খুঁজে পাই যা মালায়ালি পরিচালক টম এমাট্টি ভারতের প্রথম ম্যাচ স্মরণীয় করতে তৈরি করেছিলেন। সেই ভিডিওর ঠিক ২১ সেকন্ডের মাথায় ওই ফ্রেমটি দেখা যায়। ফলে বোঝা যাচ্ছে এটি আসল ম্যাচের নয়।
এরপর চলে আসা যাক অর্থের অভাবে জুতো না পরার দাবিতে। ভারতীয় ফুটবলের পেজ থেকে শেয়ার করা অফিশিয়াল ছবিটি ভালভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এখানে ভারতীয় দলের বেশিরভাগ সদস্য খালি পায়ে থাকলেও একজনের পায়ে জুতো ছিল।
তাহলে কি তখন ভারত সরকার মাত্র একজনের জুতোর খরচের জোগান দিতে সক্ষম ছিল! এই ছবি দেখার পর এমন হাস্যকর এবং বিস্ময়কর প্রশ্ন জাগতে বাধ্য। যা থেকে আন্দাজ করা ভাইরাল পোস্টের ওই বিশেষ দাবি সত্যি নাও হতে পারে।
এই বিষয়ে অতিরিক্ত তথ্য পেতে আমরা ইতিহাস এবং পরিসংখ্যানবিদ গৌতম রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের জানান, বুট পায়ে যে ভারতীয় ফুটবলারকে দেখা যাচ্ছে তিনি হলেন থেনমাডম ম্যাথিউস ভার্গিস, যাতে পাপ্পান বলে ডাকা হতো। ভারতীয় দলে তিনি ডিফেন্ডারের ভূমিকায় খেলতেন।
তাহলে বাকিরা খালি পায়ে কেন?
এই বিষয়ে আরও সার্চ করে আমরা দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সংরক্ষিত সংস্করণে একটি খবরের পাতা খুঁজে পাই যা ১৯৪৮ সালের ১ অগাস্ট প্রকাশ পেয়েছিল। এখানে ফ্রান্সের কাছে ভারতের পরাজয় নিয়ে খবর করা হয়।
সেই খবরে লেখা হয় যে, আটজন ভারতীয় ফুটবলার বুট ছাড়াই খেলতে নেমেছিলেন। সেই সঙ্গে আরও উল্লেখ করা হয় যে, বুট না পরলেও এতে তাঁদের শট মারার দক্ষতায় বিন্দুমাত্র আঁচড় পড়েনি। এ ছাড়াও আমরা ২০১৪ সালের ১৭ মে স্পোর্ট্স্টারে প্রকাশিত একটি খবর খুঁজে পায় যার শিরোনাম ছিল, "ব্রেভিং ইন বেয়ারফুট।"
সেই রিপোর্টের ভাষ্য অনুযায়ী, "ভারতীয় ফুটবলারা বুটজুতো ছাড়াই এতদিন ক্ষমতায় খেলে এসেছিল, তাই তারা খালি পায়েই খেলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করত। যদিও ভারত ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকের প্রথম রাউন্ডে ফ্রান্সের একটি অপেশাদার দলের কাছে হেরেছিল, তবে ব্রিটিশ মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত প্রশংসা ভারতের এই অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে (বুটজুতো ছাড়া খেলার) তাদের বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করেছিল।"
এই বিষয়ে গৌতম রায় আমাদের আরও বলেন, "সেই সময় ভারতীয়রা বুট পরে খেলতে অভ্যস্ত ছিল না, এবং সেই কারণেই বেশিরভাগ ফুটবলার সেই ম্যাচে জুতো পরেননি। ১৯৫২ সালের হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে যুগোস্লাভিয়ার বিরুদ্ধে ১-১০ গোলে হারের পরেই ভারতীয় ফুটবলে বুট বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।"
অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে যে অর্থাভাবে বুটজুতো পরে খেলতে না পরার দাবিটি সত্যি নয়। এই পোস্টে আরও একাধিক তথ্য থাকলেও আমাদের পক্ষ থেকে শুধুমাত্র এই বিষয়টিরই সত্যতা যাচাই করা হয়েছে।
১৯৪৮ সালের অলিম্পিকে অর্থাভাবের কারণে ভারতীয় দল বুট পায়নি ও খালি পায়ে খেলতে হয়েছিল।
অর্থাভাবের কারণে নয়। ভারতীয় দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড় খালি পায়েই খেলতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন তাই তাঁরা খালি পায়ে নেমেছিলেন। একই ম্যাচে কিছু ভারতীয় খেলোয়াড় বুট পরে নেমেছিলেন।