রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গত ২৫ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয় ইসকনের বহিস্কৃত নেতা তথা বাংলাদেশের সনাতনী জাগরণ জোটের মুখ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে। তাঁর গ্রেফতারের পর থেকে পুনরায় দেশটিতে হিন্দুদের ওপর হামলার খবর সামনে এসেছে। আর এই সার্বিক পরিস্থিতির মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও বেশ ভাইরাল হয়েছে।
যেখানে গেরুয়া পোশাক পরিহিত একজন ব্যক্তিকে একটি জঙ্গলের ভিতরে হাতে পিস্তল নিয়ে গুলি চালাতে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে অন্য একজন ব্যক্তিকে তার মাথার উপরে ছাতা ধরে দাঁড়ি থাকতে দেখা যাচ্ছে। ভিডিওটি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে, গেরুয়া পোশাক পরিহিত যে ব্যক্তিকে বন্দুক চালাতে দেখা যাচ্ছে তিনি একজন ইসকনের ধর্মগুরু। এবং তিনি বন্দুক চালানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
উদাহরণস্বরূপ, এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ভাইরাল ভিডিওটি শেয়ার করে সেটির ফ্রেমের উপরে লিখেছেন, “ইস কনরা প্রশিক্ষণ করছে। আর আমরা মুসলমান ঘরে বসে আছি। আজ কি হল আমাদের।” পাশাপাশি ভিডিওটির ক্যাপশনে লিখেছেন, “তারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, আর আমরা এখনো ঘুমিয়ে আছি কি হয়েছে মুসলমান তোমাদের তোমরা না খালেদ বিন ওয়ালিদের উত্তরসূরী।” (সব বানান অপরিবর্তিত।) এই একই ভিডিও ক্যাপশনে #iskcon লিখে আরও অনকেই শেয়ার করেছেন।
ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে ভাইরাল ভিডিওটির সঙ্গে বাংলাদেশ কিংবা ইসকনের কোনও সম্পর্ক নেই। আসলে ভিডিওটি থাইল্যান্ডের এবং সেখানে যে ব্যক্তিকে বন্দুক চালাতে দেখা যাচ্ছে তিনি একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী।
কীভাবে জানা গেল সত্য?
ভাইরাল ভিডিও ও দাবির সত্যতা জানতে সেটির কি-ফ্রেম সার্চ করলে চলতি বছরের ২ অক্টোবর থাইল্যান্ডের সংবাদমাধ্যম Thairath TV-র অফিশিয়াল এক্স হ্যান্ডেলে এই একই ভিডিও পাওয়া যায়। ভিডিওটি শেয়ার করে সেখানে থাই ভাষায়, জঙ্গলের ভিতরে একজন সন্ন্যাসীর গুলি চালানোর দৃশ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এরপর উক্ত সূত্র ধরে পরবর্তী সার্চ করলে ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর অপর এক থাই সংবাদমাধ্যম Thai PBS-এর অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে ভাইরাল ভিডিও-র স্ক্রিনশট-সহ একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। সেখানে জঙ্গলের ভিতরে বন্দুক নিয়ে প্রশিক্ষণরত গেরুয়া পোশাক পরিহিত ব্যক্তিকে একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি তাকে খুঁজে বার করার জন্য তদন্ত শুরু করা হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে।
এরপর এই সংক্রান্ত পরবর্তী সার্চে থাইল্যান্ডের সরকারি সংবাদমাধ্যম NBT Connext-এর অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে ভাইরাল ভিডিওর একটি স্ক্রিনশট-সহ একটি পোস্ট দেখতে পাই। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, থাইল্যান্ডের জাতীয় বৌদ্ধ অফিসের ডেপুটি ডিরেক্টর বুঞ্চিত কিট্টথারাংকুন ভাইরাল ভিডিওটি নিয়ে নিজের ক্ষোভ ও চিন্তা প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি তিনি থাইল্যান্ডের সমস্ত বৌদ্ধ মন্দির বা মঠের অধ্যক্ষদের ভাইরাল ভিডিওর ব্যক্তিকে খুঁজে বার করার জন্য প্রশাসনকে সাহায্য করার অনুরোধ জানিছেন।
এরপর ভাইরাল ভিডিওটি সম্পর্কে ইসকনের মতামত জানতে আমরা ব্যাংকক (থাইল্যান্ড) ইসকনের মুখপাত্র দেবযানী মাতাজীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের জানান, "ভাইরাল ভিডিওটির সঙ্গে ইসকনের কোনও রকমভাবেই সম্পর্ক নেই। কারণ পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে আমাদের সকল ইসকন ভক্ত ও ব্রহ্মচারীরা গৌড়ীয় বা বাঙালীদের মত করে ধুতি ও কুর্তা পরেন এবং তাদের সকলের মাথায় অবশ্যই একটি শিখা বা টিকি থাকবেই। কিন্তু ভাইরাল ভিডিওতে যে সন্ন্যাসীকে দেখা যাচ্ছে তার পোশাক ইসকন ভক্তদের মত নয়। এমনকি তার মাথায় কোনও টিকিও নেই। ভিডিওটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। কারণ তাদের পোশাক এমন হয়ে থাকে।"
আমাদের এই একই কথা জানান ইসকনের কলকাতা শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট রাধারমন দাসও। তিনি বলেন, "ইসকনের সদস্য বা ভক্ত হতে হলে তাকে অবশ্যই সনাতন ধর্মাবলম্বী ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পূজারী হতে হবে। ইসকন অন্য ধর্মের মানুষদের বিপদে পাশে দাঁড়ালেও তারা ইসকনের সদস্য বা ভক্ত হতে পারবে না। তাদের ইসকনের সদস্য হতে হলে অবশ্যই সনাতন গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি তিনি আমাদেরকে ইসকন ভক্তদের একাধিক ছবি শেয়ার করেন। ভাইরাল ভিডিওর সন্ন্যাসীর সঙ্গে রাধারমন দাসের শেয়ার করা ছবি পাশাপাশি রেখে তুলনা করলে দুটির মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।"
এর থেকে প্রমাণ হয় যে ইসকনের ধর্মগুরুর অস্ত্র প্রশিক্ষণ দাবিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করা হচ্ছে থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর ভিডিও।
ভিডিওতে ইসকনের এক ধর্মগুরুকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে দেখা যাচ্ছে।
ভিডিওটির সঙ্গে ইসকনের কোনও সম্পর্ক নেই। আসলে ভিডিওটি থাইল্যান্ডের এবং সেখানে যে ব্যক্তিকে বন্দুক চালাতে দেখা যাচ্ছে তিনি একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী।