মুর্শিদাবাদে অবস্থিত নওপাড়া মহিষাসুর নামের একটি রেল স্টেশন ভাঙচুরের ভিডিও সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ ভাইরাল হচ্ছে। এই ভিডিওতে বেশ কিছু ব্যক্তিকে হাতে বাঁশ ও নানা অস্ত্র নিয়ে স্টেশনের সম্পত্তি ভাঙতে দেখা যাচ্ছে।
ভিডিওটি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে, ট্রেনের শব্দে নামাজ পড়তে অসুবিধা হওয়ার করণে নাকি স্থানীয় মুসলিম ব্যক্তিরা স্টেশনে এভাবে উপদ্রব চালাচ্ছে। এই ভিডিওটি পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, "মুর্শিদাবাদ এ রেল স্টেশন স্থানীয় মুসলমান দের উপদ্রব। কারন ট্রেনের শব্দে নামাজ পরতে অসুবিধা। একবার ভেবে বলুন আমরা কোন দেশে বাস করি। আমাদের ভবিষ্যত কি একবার ভেবে দেখার অনুরোধ।" (ক্যাপশনের বানান অপরিবর্তিত)
একই দাবি করে আরও অনেকেই এই ভিডিওটি নিজেদের ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। যেখানে লেখা হয়েছে, "নাওপারামহিষাসুর স্টেশন মুর্শিদাবাদে ভেঙে তছনছ করলো স্থানীয় মুসলমানরা। কারনটা কি, নাহ ট্রেনের আওয়াজ নামাজ পড়তে অসুবিধা করছিলো। SEE THE FUTURE OF W.B. IN THE YEARS TO COME!!" (ক্যাপশনের বানান অপরিবর্তিত)
আজ তক ফ্যাক্ট চেক ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে এই ভিডিওটি প্রায় পাঁচ বছর আগেকার, এবং সিএএ আন্দোলনের সময়ের। নামাজ পড়ার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।
কীভাবে জানা গেল সত্যি
যদি সত্যিই এই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটে থাকত, তবে সেই নিয়ে কোনও না কোনও সংবাদ মাধ্যমে রিপোর্টও প্রকাশ পেত। কিন্তু কিওয়ার্ড সার্চ করে এমন কোনও রিপোর্ট দেখতে পাইনি। তবে এই ভিডিওতে স্পষ্টভাবে 'নওপাড়া মহিষাসুর' নামের স্টেশন দেখা যাচ্ছে।
মুর্শিদাবাদ জেলার নওপাড়া মহিষাসুর রেলওয়ে স্টেশনটি পূর্ব রেলওয়ে জোনের মালদা রেলওয়ে বিভাগের অধীনে পড়ে।
এই স্টেশনের নামটিকে সূত্র ধরে আমরা বেশ কিছু কিওয়ার্ড সার্চ করি এবং একই ঘটনার অন্যান্য বেশ কিছু ভিডিও পাই যা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে অনেকেই নিজেদের ফেসবুকে শেয়ার করেছিল। ভিডিওগুলি শেয়ার করে লেখা হয় যে এই ঘটনাটি সেই সময় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) বিরোধী আন্দোলনের অংশ।
একই ঘটনার একটি ভিন্ন ভিডিওতে ভিড়ের মধ্যে থাকা একজনকে বলতে শোনা যায়, “কোই এনআরসি নাহি চালেগা দেখো কিতনা লোগ হ্যায়। সব লগ আ জায়েগা তো কেয়া করেগা মোদী জি ,” যার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “এখানে এনআরসি হবে না। এখানে মানুষের সংখ্যা দেখুন। মোদীজী জনতার সামনে অসহায়।"
বাস্তবে কী ঘটেছিল তার সত্যতা যাচাই করতে আমরা মালদার ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) য়েতেন্দ্র কুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তিনি সরাসরি ভাইরাল ভিডিওর দাবি প্রত্যাখান করে বলেন, “এই ভিডিওটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে হওয়া একটি সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভের। ট্রেনের হর্ন বা নামাজের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।" তিনি আরও বলেন, নওপাড়া মহিষাসুর রেলস্টেশনে সাম্প্রতিক অতীতে এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি।
আজিমগঞ্জ-নলহাটি সেকশনের রেলওয়ে প্যাসেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অবনি প্রামাণিক, যার অধীনে নওপাড়া মহিষাসুর রেলওয়ে স্টেশন পড়ে, তিনিও নিশ্চিত করেন যে ভিডিওটিতে CAA বিরোধী বিক্ষোভকারীরা দেখানো হয়েছে, যারা সেই সময়ে মুর্শিদাবাদের বেশ কয়েকটি রেল স্টেশন ভাঙচুর করেছে বলে অভিযোগ।
এরপর আমরা আরও কিছু কিওয়ার্ড সার্চ করে বর্তমান পত্রিকার একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাই যা ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশ পেয়েছিল। সেখানেও নওপাড়া মহিষাসুর রেলওয়ে স্টেশনে ভাঙচুরের কথা উল্লেখ করা হয়। এই খবর অনুসারে, ১৪ ডিসেম্বর সিএএ বিরোধী আন্দোলনে মুর্শিদাবাদের নানা জায়গায় ভাঙচুর চালানো হয়েছিল।
প্রতিবেদনে পুলিশ সূত্র উদ্ধৃত করে বলা হয় যে যে বিক্ষোভকারীরা নিমতিতা, পেয়ারাডাঙ্গা এবং নওপাড়া মহিষাসুর স্টেশনে জড়ো হয়েছিল এবং সেদিন সকালে ভাঙচুর শুরু করে। ওই বছর 14 ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতেও সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে , বিক্ষোভকারীরা বাস, ট্রেন, রেলস্টেশনে আগুন দিয়ে এবং সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের এপ্রিল মাসেও এই একই মিথ্যে দাবি করে এই ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল, তখনও ইন্ডিয়া টুডের পক্ষ থেকে এই ভিডিওটির ফ্যাক্ট চেক করা হয়।
অর্থাৎ বুঝতে বাকি থাকে না যে এই ভিডিওটি কোনও ভাবেই ট্রেনের হর্নের শব্দ বা নামাজ পড়ার সঙ্গে জড়িত নয়।
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে মুসলিমরা মুর্শিদাবাদের নওপাড়া মহিষাসুর স্টেশন ভাংচুর করছে কারণ ট্রেনের হর্ন তাদের নামাজে বাধা দিয়েছে।
এই ভিডিওটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের যখন পশ্চিমবঙ্গে সিএএ বিরোধী আন্দোলন চলছিল। এর সঙ্গে নামাজ বা ট্রেনের হর্নের কোনও সম্পর্ক নেই।