সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিয়ো বেশ ভাইরাল হয়েছে। ভিডিয়োটিতে মাইক হাতে নিয়ে এক ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে শপথ বাক্য পাঠ করাতে। তাঁকে অনুসরণ করে বাকিরাও দেখাদেখি সেই শপথ বাক্য পাঠ করছেন। ভিডিয়োতে থাকা বাকি ব্যক্তিদের কয়েকজনের হাতে ভারতের জাতীয় পতাকাও লক্ষ্য করা যাবে।
এই ভিডিয়োটি শেয়ার করে 'দ্য রেনবো' নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে লেখা হয়েছে, "পাকিস্তানের POK থেকে ভারতের জন্য শপথ বাক্য পাঠের ভিডিও ভাইরাল, জোর চর্চা আন্তর্জাতিক মিডিয়া গুলোতে।"
একই দাবিতে ফেসবুকে অন্যানরাও এই ভিডিয়োটি শেয়ার করে দাবি করেছেন, এটি পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের একটি দৃশ্য।
আজ তকের ফ্যাক্ট চেক টিম অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, ভাইরাল হওয়া ভিডিয়োটি পাক অধিকৃত কাশ্মীর নয়, বরং ভারতের অন্তর্গত কাশ্মীরের উরি জেলার দৃশ্য। এটি বিভ্রান্তিকর দাবির সঙ্গে ভাইরাল করা হচ্ছে।
কীভাবে জানা গেল সত্যি?
ভিডিয়োটির ঠিক ২০ সেকেন্ডের মাথায় একটি ছেলেকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে। সেই কাগজে ইংরেজিতে লেখা, "GUJJAR BAKARWAL EKTA ZINDABAAD।" এই বিষয়টিকে সূত্র ধরে আমরা নিজেদের অনুসন্ধান এগিয়ে নিয়ে যাই।
এরপর আমরা ভাইরাল ভিডিয়োটির কিফ্রেম রিভার্স সার্চ করি। তখন ওই একই ভিডিয়ো আমরা দেখতে পাই 'বীর গুজ্জর সেনা' নামের একটি ফেসবুক পেজে।
গত ১৯ অগস্ট এই ভিডিয়োটি পোস্ট করে ওই পেজ থেকে লেখা হয় যে, কাশ্মীরের গুজ্জর-বকরওয়াল সমাজ ১৫ অগস্ট নিজেদের যুবকদের সঙ্গে নিয়ে শপথ নিয়েছে যে তাঁরা ভারতের সংবিধান ও আইন-কানুন রক্ষার্থে সর্বদা নিজে দেশের সেনার পাশে রয়েছে ও প্রয়োজন পড়লে জীবন বাজি লাগাতেও পিছু হটবে না।
এই পেজের অ্যাডমিন তাহির চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাহির আমাদের জানান যে এই ভিডিয়োটি পাক অধিকৃত কাশ্মীর নয়, বরং ভারতের অন্তর্গত কাশ্মীরের বারামুলা জেলার উরি এলাকার ভিডিয়ো। তাঁর কথায়, এই ভিডিয়োটি ১৫ নয়, বরং ১৬ অগস্ট রেকর্ড করা হয়েছিল। কারণ ১৫ অগস্টের দিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্দেশ জারি করা হয়েছিল যে কোনও ধরনের ধর্না বা বিক্ষোভ প্রদর্শন করা যাবে না।
এরপর আমরা 'ট্রাইবাল বাঁচাও মার্চ' নামের ফেসবুক পেজেও ভাইরাল ভিডিয়োটি খুঁজে পাই। গত ১৯ অগস্ট এই পেজে ভিডিয়োটি পোস্ট করে লেখা হয়, সংবিধানের আওতায় থেকে নিজেদের শিডিউল ট্রাইব মর্যাদা রক্ষা করার শপথ উরিতে নিয়েছে গুজ্জর-বকরওয়াল গোষ্ঠীর যুবকেরা। এই ভিডিয়োর ক্যাপশনে একদম শেষে আমরা 'Rafiq Bhalote BDC Zindabad' লেখা দেখতে পাই।
এই কিওয়ার্ড সার্চের করে আমরা গ্রেটার কাশ্মীরের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাই যা ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর প্রকাশ পেয়েছিল। সেখানে লেখা হয়, রফিক ভালোট উরির ব্লক ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল (BDC)-এর চেয়ারম্যান এবং তাঁর বিরুদ্ধে যে অনাস্থা প্রস্তার আনা হয়েছিল তা ব্যর্থ হওয়ায় তিনি-ই চেয়ারম্যান পদে থাকবেন।
কাশ্মীরের দুটি স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম অনুযায়ী, রফিক ভালোট উরি বিডিসি-র চেয়ারম্যানের পাশাপাশি গুজ্জর-বকরওয়াল জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটির (GBJAC) সাধারণ সম্পাদকও বটে।
এরপর আমরা কাশ্মীরের গ্রামোন্নয়ন দফতরের ওয়েবসাইট থেকে রফিক ভালোটের নম্বর নিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। রফিক আমাদের বলেন, "মাইক হাতে আমাকেই দেখা যাচ্ছে। এটি বারামুলা জেলার লাগামা ডাক বাংলোর ঘটনা। স্বাধীনতা দিবসের পরদিন আমরা একত্রিত হয়ে শপথ নিয়েছিলাম যে সংবিধানের গণ্ডিতে থেকে ও সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়িয়ে যে ভাবেই হোক নিজেদের এসটি মর্যাদা রক্ষা করব। উঁচু গোষ্ঠীর মানুষদের এসটি-র তালিকাভুক্ত করা হলে সেটা আমরা মেনে নেব না। আমরা ছোট থেকেই দেশকে ভালবেসে বড় হয়েছি। কেউ যদি বলে এটি পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ঘটনা তবে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।"
গুজ্জর-বকরওয়ালদের ক্ষোভের কারণ কী?
অগস্ট প্রকাশিত দ্য হিন্দুর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, গুজ্জর-বকরওয়াল হল যারা জম্মু-কাশ্মীরের মুসলিম সম্প্রদায়ের অংশ যারা এসটি তালিকাভুক্ত। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার গত ২৬ জুলাই লোকসভায় একটি বিল নিয়ে আসে। যেই বিল পাশ হয়ে আইনে পরিণত হলে, "গাড্ডা ব্রাক্ষ্মণ", "কোলি", ও "পাহাড়ি ট্রাইব" নামের তিনটি জাতিগোষ্ঠী কেন্দ্রশাসিত জম্মু কাশ্মীরের শিডিউল ট্রাইব (এসটি)-এর তালিকায় চলে আসবে। গুজ্জর-বকরওয়ালদের দাবি, এই গোষ্ঠীগুলি এসটি তালিকার অন্তর্ভুক্ত হলে এটি তাদের সাংবিধানিক অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে যা দীর্ঘ লড়াই করে পেতে হয়েছে।
অর্থাৎ এটা বুঝতে বাকি থাকে না যে, ভারতের জম্মু-কাশ্মীরে একটি গোষ্ঠীগত স্বার্থ রক্ষার্থে গুজ্জর-বকরওয়ালদের একটি শপথ বাক্য পাঠ করার ভিডিয়ো সম্পূর্ণ মিথ্যে দাবিতে ভাইরাল করা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে, পাক অধিকৃত কাশ্মীরের বাসিন্দারা ভারতের জন্য় শপথ বাক্য পাঠ করছেন।
ভিডিয়োটি পাক অধিকৃত কাশ্মীর নয়, বরং বারামুলা জেলার উরি এলাকার। গত অগস্ট মাসে জম্মু-কাশ্মীরের গুজ্জর বকরওয়াল নামের একটি মুসলিম গোষ্ঠী নিজেদের এসটি মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে এই শপথ বাক্য পাঠ করে।