সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন রাজ্যের সরকার অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। তবে অনেকক্ষেত্রে বাংলাদেশি সন্দেহে এরাজ্যের বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্তা করা হচ্ছে বলে একাধিকবার অভিযোগ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এই সার্বিক পরিস্থিতির মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ ভাইরাল হয়েছে একটি ভিডিও।
যেখানে বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে একটি আবাসনের বেসমেন্টে অপর এক ব্যক্তির পায়ে দড়ি বেঁধে উল্টো ঝুলিয়ে তাকে মারধর করতে দেখা যাচ্ছে। ভিডিওটি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে, বিজেপি শাসিত রাজ্যে একজন বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিককে উল্টো করে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে মারধর করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ভাইরল ভিডিওটি শেয়ার করে লিখেছেন,“বাঙালির উপর অমানবিক অত্যাচার দেখেও বাঙালি চুপ থাকে তবে বুঝবো বাঙালির শিরদাঁড়া বাঙালি বি.জেপির কাছে বিকিয়ে দিয়েছে! 😥😥 #জাগো_বাঙালি।” (সব বানান অপরিবর্তিত)
ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, ভাইরাল ভিডিওটি চলতি বছরের জুন মাসে হরিয়ানার গুরগ্রামের একটি আবাসনের ঘটনা এবং ভিডিওর নির্যাতিত যুবক বাঙালি নয় বরং একজন উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা।
সত্য উন্মোচন হলো যেভাবে
ভাইরাল দাবি ও ভিডিওটির সত্যতা জানতে সেটি থেকে একাধিক কিফ্রেম নিয়ে গুগলে রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে ২০২৫ সালের ২৯ জুলাই একটি এক্স হ্যান্ডেলে এই একই ভিডিও-সহ একটি পোস্ট পাওয়া যায়। সেই পোস্ট থেকে জানা যায়, একটি চুরির ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে প্রায় দেড় মাস আগে গুরগ্রামের সেক্টর-৩৭ এলাকাকার একটি আবাসনে এক ব্যক্তিকে উল্টো ঝুলিয়ে নির্মমভাবে মারধর করে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি। তবে এত সম্প্রতি এই ঘটনার ভিডিও প্রকাশ্যে আসতেই গুরগ্রাম পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিতভাবে একটি এফআইআর দায়ের করে এবং ঘটনায় অভিযুক্ত ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে।
এরপর উক্ত তথ্যের উপরে ভিত্তি করে পরবর্তী অনুসন্ধান চালালে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ভাইলার ভিডিওর স্ক্রিনশট-সহ এই সংক্রান্ত একাধিক প্রতিবেদন পাওয়া যায়। সেই সব প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত জুন মাসের ১০ অথবা ১১ তারিখ রাতে গুরগ্রামের সেক্টর-৩৭সি এলাকার একটি নির্মীয়মাণ আবাসন থেকে বৈদ্যুতিক তার চুরির অভিযোগে ওই আবাসনে কর্মরত এক জেসিবি চালককে উল্টো ঝুলিয়ে বেধড়ক মারধর করে আবাসনের বেশ কয়েকজন কর্মী। এরপর এই ঘটনার ভিডিও প্রকাশ্যে আসতেই গুরগ্রাম পুলিশ গুরগ্রামের সেক্টর ১০/এ থানায় স্বতঃপ্রণোদিতভাবে একটি এফআইআর দায়ের করে এবং ঘটনায় অভিযুক্ত চারজন নিরাপত্তারক্ষীকে গ্রেফতার করে। অভিযুক্তরা হল পুষ্পেন্দ্র, অজিত সিং, কৃষ্ণ কুমার এবং অমিত কুমার।
চলতি বছরের ৩০ জুলাই এনডিটিভির অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত এই সংক্রান্ত প্রতিবেদনে গুরগ্রাম পুলিশের বিবৃতি থেকে জানা যায়, ভাইরাল ভিডিওতে নির্যাত ব্যক্তি রাজস্থানের বাসিন্দা। ৩০ জুলাই গুরগ্রাম পুলিশের অফিশিয়াল এক্স হ্যান্ডেলেও এই সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশ করে ভাইরাল ভিডিওর নির্যাত ব্যক্তিকে রাজস্থানের বাসিন্দা হিসাবে উল্লেখ করা হয়। তবে আমরা আমাদের অনুসন্ধানে এমন কোনও তথ্য বা প্রতিবেদন খুঁজে পাইনি যেখানে, নির্যাত ব্যক্তিকে বাঙালি বলে উল্লেখ করা হয়েছে কিংবা তাকে বাঙালি হওয়ার কারণে মারধর করা হয়েছে।
এরপর বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমরা গুরগ্রামের সেক্টর ১০/এ থানার এসএইচও সন্দীপ কুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন যে, “প্রাথমিক তদন্তে প্রাপ্ত সূত্রের উপরে ভিত্তি করে আমাদের মনে হয়েছিল ভাইরাল ভিডিওর নির্যাতিত ব্যক্তি রাজস্থানের বাসিন্দা। তবে পরবর্তীতে তাকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আমরা জানতে পারি সে রাজস্থানের নয় বরং উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা। অন্যদিকে ভিডিওটি প্রকাশ্যে আসতেই গত ২৮ জুলাই আমরা এই ঘটনায় যুক্ত চার অভিযুক্তকে এবং ৩০ জুলাই যোগেন্দ্র ভাটি নামক অপর আর এক অভিযুক্তকে গ্রেফতার করি। অর্থাৎ এখনও পর্যন্ত এই ঘটনায় মোট ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখানে অভিযুক্ত এবং নির্যাতিত কেউই বাঙালি নয়।” আজ তকের গুরগ্রাম জেলা সাংবাদিক নীরজ বশিষ্ঠ এবং গুরগ্রাম পুলিশের পিআরও-এর তরফেও আমাদের এই একই তথ্য প্রদান করা হয়েছে। আজ তক ফ্যাক্ট চেক নিরাপত্তার স্বার্থে ওই ব্যক্তির নাম প্রকাশ করছে না।
এর থেকে প্রমাণ হয় যে, বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাঙালি নির্যাতন দাবিতে শেয়ার করা হচ্ছে অসম্পর্কিত ভিডিও।
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি শাসিত রাজ্যে একজন বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিককে উল্টো করে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে মারধর করা হচ্ছে।
ভাইরাল ভিডিওটি চলতি বছরের জুন মাসে হরিয়ানার গুরগ্রামের একটি আবাসনের ঘটনা এবং ভিডিওর নির্যাতিত যুবক বাঙালি নয় বরং একজন উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা।