হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। শতাব্দী প্রাচীন লাল বাড়ির গণ্ডি ছাড়িয়ে যাঁর নাম ফিরছে রাজ্যবাসীর মুখে মুখে। সেই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়োগ দুর্নীতি মামলা থেকে সরানোর নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ জানাল, নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত যে মামলা বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় শুনছিলেন সেগুলির শুনানিতে এবার অন্য বিচারপতি নিয়োগ করা হোক। গত কয়েক মাস ধরে একের পর এক মামলায় অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়, পর্যবেক্ষণ স্নায়ুর চাপ বাড়িয়েছিল শাসক দলের। কেন তিনি এত আলোচিত?
চাকরি প্রার্থী থেকে রাজ্যের আমজনতা- রীতিমতো মসিহা হয়ে উঠেছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। একের পর এক দুর্নীতি মামলায় দিয়েছিলেন সিবিআই তদন্তের নির্দেশ। সেই সব তদন্তে ধরা পড়েছে একে একে রাঘববোয়াল। রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় থেকে পরেশ অধিকারীকে সিবিআই জেরার মুখোমুখি হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে মন্ত্রী-কন্যা অঙ্কিতার চাকরিও বাতিল করেছিলেন। নেট মাধ্যম তো বটেই পাড়ায়-পাড়ায় অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন পরিচিত মুখ। যাঁরা যোগ্য প্রার্থী তাঁদের নিয়োগের নির্দেশও দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। যে টেলিভিশন সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, সেখানেই তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, দুর্নীতির শেষ দেখতে চান। ঘটনা হল, নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ইতিমধ্যেই তৃণমূলের তিন বিধায়ক পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জীবনকৃষ্ণ সাহা ও মানিক ভট্টাচার্যকে গ্রেফতার করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সেই সঙ্গে ধরা পড়েছে কুন্তল, শান্তনু ও অয়নের মতো মিডলম্যানরাও। আর এক বিধায়ক তাপস সাহাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিবিআই। কার্যত নিয়োগ দুর্নীতির প্যান্ডারোর বাক্স খুলে দিয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
আইনের পথে কেরিয়ারের শুরুতেই হাঁটেননি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। শুরুতে সরকারি চাকরি করেছিলেন। সে কথা নিজের সাক্ষাৎকারে বলেওছিলেন। তবে বেশিদিন সেই চাকরি করেননি তিনি। আইন নিয়ে পড়াশুনো করেন। আইনজীবী হিসেবে বহু মামলা লড়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল ইন্সিওরেন্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলাও। ১০ বছর তিনি আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৮ সালের ২ মে কলকাতা হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে যোগ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। ২০২০ সালের ৩০ জুলাই থেকে হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। তার পর ২০২১ সাল থেকেই একের পর এক নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় নির্দেশ দিয়েছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতার স্কুল শিক্ষিকার চাকরি বাতিল করেছেন। ৪১ মাসের টাকা ফেরত দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন- বিজেপির বিকাশ, সিপিএমের বিকাশ! সুপ্রিম-রায়ে এক ঢিলে দুই শিকার কুণালের
শুধু যে দুর্নীতি মামলা তাই-ই নয়,৭৬ বছরের বৃদ্ধা শিক্ষিকা শ্যামলী ঘোষকে ২৫ বছরের বকেয়া বেতন পাইয়ে দিয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। এজলাসেই কান্নায় ভেঙে পড়েন শ্যামলী। আশীর্বাদ করেছিলেন বিচারপতিকে। ক্যানসার আক্রান্ত শিক্ষিকার ১২ দিনের বেতন কেটে নেওয়ায় প্রধান শিক্ষকের বহিষ্কার করেছিলেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। আন্দোলনকারী চাকরিপ্রার্থীরাও তাঁর ভরসায়। ক্যানসার আক্রান্ত সোমাকে ব্যক্তিগতভাবে ডেকে পাঠিয়ে বিকল্প চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন মানবিক বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। রাজি হননি সোমা। সকলের সঙ্গে চাকরি পেতে চেয়েছিলেন।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষণা করা বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে পড়তে হয়েছে শাসক দলের নিশানায়। তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে বিচারপতির এজলাস বয়কটের ডাক দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন। তৃণমূলপন্থী আইনজীবীদের বিক্ষোভের মুখেও বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন,'মাথায় বন্দুক ধরে মারতেও পারেন। মরতে রাজি। তবে দুর্নীতি দেখলে চুপ করে থাকব না। আওয়াজ তুলবই।'
তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশের উপর বারবার ডিভিশন বেঞ্চের স্থগিতাদেশের রায় নিয়ে উষ্মাপ্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দিয়েছিলেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। যা হাইকোর্টের ইতিহাসে বিরল। তাঁর পর্যবেক্ষণও অনন্য। যা বারেবারে জায়গা পেয়েছে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে। চুম্বকে, ঐতিহাসিক লাল বাড়ির চত্বর থেকে বাংলার নায়ক হয়ে উঠেছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। স্মরণাতীতকালে যা ঘটেনি।