বাসে করে তারাতলা মোড় ঘুরতেই ম-ম করত বিস্কুটের সুগন্ধ। সেই ভ্যানিলা-ময়দার সুন্দর গন্ধ আর পাবেন না কলকাতাবাসী। শহর থেকে পাততাড়ি গোটাচ্ছে ব্রিটানিয়া। বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে তারাতলার ব্রিটানিয়ার কারখানা।
বিস্কুট বলতেই যে কয়েকটি কোম্পানির নাম আসে, তার মধ্যে অন্যতম ব্রিটানিয়া। স্বাধীনতার আগে থেকেই দেশে বিস্কুটের ব্যবসা সংস্থার। সেই ব্রিটানিয়ারই অন্যতম বড় কারখানা ছিল কলকাতার তারাতলায়। সম্প্রতি সংস্থা জানায়, তাদের কলকাতা ইউনিট বন্ধ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই সেখানকার কর্মীদের নোটিশ দিয়ে ব্রিটানিয়া এই বিষয়ে জানিয়ে দিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অন্যতম ইস্যু শিল্পের অভাব। কল-কারখানার মতোই বেকারি মানেও কর্মসংস্থান। সেই রুজি-রুটিরই অন্যতম উৎস ব্রিটানিয়ার কারখানা উঠে যাওয়ায় শুরু হয়েছে তুমুল রাজনৈতিক তরজা। বিজেপি এবং টিএমসি একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলছে।
ব্রিটানিয়ার তারাতলার কারখানার ইতিহাস
স্বাধীনতার বহু আগের কথা। আজ ব্রিটানিয়ার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। কিন্তু শুরুটা ছিল অনেক সাদামাটা। ১৮৯২ সালে কলকাতার একটি ছোট দোকান থেকে যাত্রা শুরু। মাত্র ২৯৫ টাকা বিনিয়োগ করে ব্যবসা শুরু হয়েছিল।
বিস্কুট খাবারটাই ব্রিটিশ উদ্ভাবন। তাই ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরাই এই বিস্কুটের কারবার শুরু করেছিলেন। পরে এটি ওয়াদিয়া পরিবারের হাতে আসে।
ওয়াদিয়া পরিবারের হাতে আসার পরেই বিদেশি বিস্কুটে আসে ভারতীয় ছোঁয়া। ১৯১০ সালে, সেই সময়কার হিসাবে অত্যাধুনিক বৈদ্যুতিক মেশিনের সাহায্যে বিস্কুট তৈরি শুরু হয়। তারপর ১৯২১ সালে, উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য, বিদেশ থেকে গ্যাস ওভেন নিয়ে আসা হয়। এরপর বিক্রি এতই বেড়ে যায় যে একটা কারখানায় আর সামলানো যাচ্ছিল না। ১৯২৪ সালে মুম্বইতে আরও একটি কারখানা স্থাপন করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই ব্রিটানিয়ার ব্যবসায় দুরন্ত গতি আসে। সস্তায় জলখাবার, চায়ের সঙ্গে 'টা' হিসাবে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় ব্রিটানিয়া।
১৯৪৭ সালে, স্বাধীনতার বছরেই কলকাতার তারাতলার এই কারখানায় পুরোদমে উৎপাদন শুরু করে ব্রিটানিয়া।
৯০০০ কোটি টাকার ব্যবসা
বর্তমানে ব্রিটানিয়া ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবসা বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে। ব্রিটানিয়ার ভারতে ১৩টি কারখানা রয়েছে। কোম্পানির বার্ষিক আয় ৯,০০০ কোটি টাকারও বেশি।
প্রায় এক বছর আগে থেকেই উৎপাদন বন্ধ ছিল
২০২৩ সালের মে থেকেই তারাতলার ব্রিটানিয়া কারখানা বন্ধ ছিল। এবার ধীরে ধীরে পাততাড়ি গোটানো শুরু করল ব্রিটানিয়া। ঐতিহাসিক এই কারখানাটি বন্ধ হওয়াটা কেবল শহরের ঐতিহ্যের জন্যই নয়, কর্মীদের জন্যও একটা খুব খারাপ খবর।
কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত বছরের মে থেকেই এই ইউনিটে উৎপাদন বন্ধ ছিল। এখন এটি সম্পূর্ণ বন্ধ করার ঘোষণা করা হয়েছে।
সংস্থা চাকরি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নেওয়া কর্মীদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়েছে। ব্রিটানিয়ার এই ইউনিটে ১২২ জন স্থায়ী কর্মচারী এবং প্রায় ২৫০ জন চুক্তিভিত্তিক কর্মী কাজ করতেন। অনেকেই এখানে গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছিলেন।
কারখানা বন্ধে রাজনীতির ঝড়
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলছেন, 'এমন একটি দলের উপস্থিতিতে, যারা সারাক্ষণ তোলাবাজি করে, সেখানে শিল্প আসবে না। মুখ্যমন্ত্রীরও শিল্প-বিরোধী ভাবমূর্তি রয়েছে।'
বিজেপি নেতা অমিত মালব্য তাঁর টুইটার (এখন এক্স) অ্যাকাউন্টে পোস্টে রাজ্য সরকারের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, 'আজ ব্রিটানিয়া ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানা বন্ধ হওয়া বাংলার পতনের প্রতীক।'
অন্যদিকে, বিজেপির আক্রমণের পাল্টা আঘাত হেনে TMC নেতা কুণাল ঘোষ বলছেন, 'সংশ্লিষ্ট সংস্থার ম্যানেজমেন্টের নিজস্ব সমস্যা রয়েছে। যারা এটিকে রাজ্যের সামগ্রিক শিল্প পরিস্থিতির সঙ্গে মেশাচ্ছেন, তাঁরা ভুল করছেন।'