পুজোর রাতে কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে এক অদ্ভুত ও ভীতিকর দৃশ্য ফুটে ওঠে। আদি গঙ্গার তীরে অবস্থিত এই শ্মশানে একদিকে শ্মশানকালীর পুজো, অন্যদিকে পাশেই জ্বলতে থাকা চুল্লিতে শবদাহ— এই দ্বৈত ঘটনাই এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। স্থানীয় ডোমরা জানাচ্ছেন, প্রতি বছরই পুজোর রাতে মন্দির সংলগ্ন কাঠের চুল্লিতে একাধিক মৃতদেহ পুড়তে দেখা যায়, যা পুজোর সঙ্গেই চলতে থাকে। যদিও আধুনিকীকরণের ফলে এই মহাশ্মশান আজ পুরোপুরি বদলে গেছে, আগের মতো আর সেই ভয়ঙ্কর পরিবেশ নেই, তবুও পুজোর রাতে সেই আগের দিনের মতোই শবদাহ আর পূজার অদ্ভুত সমান্তরাল ছবি গায়ে কাঁটা দিতে বাধ্য করে।
কেওড়াতলার ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে উত্তম দত্ত, শ্মশানকালীর পূজা কমিটির তরফে জানালেন, কেওড়াতলা শ্মশানকালীর পুজো ১৪৯ বছরের প্রাচীন এবং এর প্রবর্তন হয়েছিল ১৮৭০ সালে। স্থানীয় একজন কাপালিক দুজন ব্রাহ্মণের সাহায্যে এই মন্দিরে প্রথম শ্মশানকালীর আরাধনা করেন। সে সময় থেকে এখানে কাপালিক নিজের আনা দুই হাত বিশিষ্ট এবং জিহ্বাহীন প্রতিমাতেই পুজো শুরু করেন, যা আজও বহন করে চলেছে সেই ঐতিহ্য।
এই পুজোর অদ্ভুত রীতি অনুযায়ী, প্রতিমা প্রতিষ্ঠা এবং আরাধনার পরে এখানকার ডোমেরা প্রতিমা নিয়ে পুনরায় শ্মশানের নির্দিষ্ট স্থানে ফিরে আসেন। উত্তমবাবু আরও জানালেন, একদিকে শবদাহ চলছে এবং অন্যদিকে পুজোর অমোঘ মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে— এমন দৃশ্য প্রতিটি পুজোতেও ভীতিকর অনুভূতির সৃষ্টি করে। প্রতি বছরই এই সময় অন্তত একটি মৃতদেহ দাহ করার জন্য আনা হয়, এবং এটি যেনও কোনো এক অলৌকিক নিয়মেই ঘটে চলেছে। তাঁর কথায়, "বছরের পর বছর এই সময় ঠিক এমনটাই দেখে আসছি। বিষয়টি কাকতলীয় হলেও এতে যেন এক গভীর রহস্য রয়েছে, যা এই শ্মশানের পুজোকে আরও বিস্ময়কর করে তোলে।"
উত্তমবাবুর কথায়, 'কেওড়াতলার শ্মশানকালী পুজো শুধুমাত্র পুজো নয়, বরং এক ঐতিহ্যবাহী রাত যা ভীতিকর রীতি এবং অদ্ভুত সময়ের মিলনে এক বিশেষ অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে। শোনা যায় দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে কারও কঠিন রোগ থেকে মুক্তিলাভ ঘটেছে, আবার কারও কারও মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে এবং হচ্ছে। জনশ্রুতি আছে যে, এখানে মায়ের পূজার সময় শ্মশান চিতা খালি যায় না। কোনওবছর এর অন্যথা হয়নি। একদিকে শ্মশানকালীর পুজো চলবে, অন্যদিকে হবে শবদাহ। ভোরবেলায় দেবীর ঘট বিসর্জন দিয়ে পুজোর সমাপ্তি হবার আগে চিতা একবার জ্বলবেই জ্বলবে। এইরকম বিশ্বাস মানুষের মনে গাঁথা।'