এও যেন ট্যাংরার সেই ভয়াবহ কাণ্ডেরই পুনরাবৃত্তি। বৃদ্ধ দম্পতি ও তাঁদের ছেলের দেহ উদ্ধার হল ফ্ল্যাটে। কলকাতার কসবায় যা ঘটল, তাতে ফের প্রশ্ন উঠছে, মানসিক অবসাদ সমাজে কতটা গভীর ভাবে ছেয়ে গিয়েছে। কলকাতা শহর আবার কেঁপে উঠল এক অকল্পনীয় মর্মান্তিক ঘটনায়। দক্ষিণ কলকাতার কসবার রাজডাঙা গোল্ড পার্কের একটি বহুতলের ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হল একই পরিবারের তিন সদস্যের ঝুলন্ত দেহ। মৃত্যুর আগেই তাঁরা রেখে গিয়েছেন একটি সুইসাইড নোট— যাতে লেখা, 'ঈশ্বরের দেওয়া প্রাণ, ঈশ্বরের সঙ্গেই মিশে যাচ্ছি। স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করছি।' এই একটি লাইন যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে, কতটা অসহায় হয়ে উঠেছিলেন সরজিৎ ভট্টাচার্য, তাঁর স্ত্রী গার্গী ও বিশেষভাবে সক্ষম ছেলে আয়ুষ্মান।
তিনজনের হাতের শিরা কাটা, রক্ত শুকিয়ে গিয়েছে
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রতিবেশীদের সন্দেহ হয়, কারণ সকাল থেকে ৫০ নম্বর ফ্ল্যাটের দরজা একবারও খোলেনি। বেল বাজিয়েও কোনও সাড়া নেই। পরিচারিকাও ফিরে যান। অবশেষে খবর যায় কসবা থানায়। পুলিশ এসে দেখে, কোলাপসিবল গেট ভিতর থেকে বন্ধ। দরজাও তালাবন্ধ। বাধ্য হয়ে দরজা ভেঙে যখন পুলিশ ঢোকে, সামনে উঠে আসে এক ভয়ংকর দৃশ্য। ডাইনিং রুমে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছেন বাড়ির কর্তা, ৭০ বছরের সরজিৎ। ভিতরের ঘরে একইভাবে ঝুলছেন স্ত্রী গার্গী (৬৮) ও ৩৮ বছরের ছেলে আয়ুষ্মান। তিনজনের হাতের শিরা কাটা, রক্ত শুকিয়ে গিয়েছে। পরে সেখানেই মেলে সুইসাইড নোট— যা একদিকে মর্মান্তিক, অন্যদিকে সমাজের সামনে এক কঠিন প্রশ্ন তুলে দেয়।
'তিন মাসের ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল দিতে পারিনি'
সুইসাইড নোটে শুধু আত্মহত্যার কথা নয়, রয়েছে অনুরোধও— যেন তাঁদের মরদেহগুলি সৎকার করা হয় সম্মানের সঙ্গে। বাড়িওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে, 'তিন মাসের ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল দিতে পারিনি। আপনার কাছে কিছু টাকা আগাম দেওয়া আছে, যদি বাকিটা মকুব করেন।' পুলিশ জানিয়েছে, সরজিৎবাবু মিউচুয়াল ফান্ড ব্রোকার ছিলেন, কিন্তু বিশেষ রোজগার করতেন না। স্ত্রী ছিলেন একটি বেসরকারি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা। ছেলেকে নিয়েই তাঁদের বেশি উদ্বেগ। আয়ুষ্মানের পায়ে সমস্যা ছিল, মানসিকভাবেও ছিলেন বিপর্যস্ত। গত আড়াই বছর ধরে এই ভাড়া বাড়িতেই থাকতেন তাঁরা। ধীরে ধীরে সঞ্চিত টাকাও শেষ হয়ে যায়, দেনায় ডুবে যান। পাওনাদারদের চাপ বাড়তে থাকে। সেই চাপ, অপমান, হতাশাই শেষ পর্যন্ত নিয়ে যায় তাঁদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে।
কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল একটি গোটা পরিবার?
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, আত্মহত্যার আগে সম্ভবত তিনজনেই শিরা কাটেন। কিন্তু তাতেও মৃত্যু না হওয়ায় গলায় দড়ি দেন। এই ঘটনা আত্মহত্যা না খুন, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, পুলিশ প্রাথমিকভাবে একে ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’র দিকেই ঝুঁকছে— কারণ ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল এবং সুইসাইড নোটের বয়ান অত্যন্ত স্পষ্ট। ঘটনার নৃশংসতা যতটা, তার চেয়েও বেশি ভয়াবহ হল এ প্রশ্ন— কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল একটি গোটা পরিবার? শুধু আর্থিক অনটনের দায়েই কি মৃত্যু বেছে নেওয়া যায়? যদি সত্যিই তাই হয়, তাহলে কি আমাদের সমাজ, আমাদের সিস্টেম কোনও সহানুভূতি, কোনও সহায়তা দিতে পারছে না?
সহানুভূতির অভাব কত ভয়ংকর হতে পারে
কসবার এই ঘটনা যেন একটা অশ্রুত চিৎকার। একটা গোটা পরিবার চলে গেল নিঃশব্দে। শুধু থেকে গেল দেওয়ালে ঝুলে থাকা তিনটি দেহ— আর একটি অসহায় বাক্য: 'আমরা স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করলাম…'। এ ঘটনা মনে করিয়ে দেয়, সহানুভূতির অভাব কত ভয়ংকর হতে পারে। সমাজের নিস্তব্ধ অমানবিকতা কতটা গভীর হলে, এক বৃদ্ধ দম্পতি ও তাঁদের ছেলেকে এভাবে প্রাণ ত্যাগ করতে হয়। মৃত্যুর আগে যাঁদের শেষ অনুরোধ ছিল, 'আমাদের যেন ভাল করে সৎকার করা হয়'— সেটুকুই যেন অন্তত পূর্ণ হয় মানবিক মর্যাদায়।