কলকাতার বড়বাজারের মেছুয়ার ফলপট্টির হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১৪। তাঁদের মধ্যে আনন্দ পাসোয়ান নামে এক জন আগুন থেকে নিজেকে বাঁচাতে উপর থেকে ঝাঁপ দেন। তাঁকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। মৃতের তালিকায় রয়েছে দুই শিশুও। এই ঘটনা ফিরিয়ে এনেছে স্টিফেন কোর্ট, আমরির স্মৃতি। মঙ্গলবার রাতে বড়বাজারের হোটেলে এই ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ড ঘটে। গোটা ঘটনায় হোটেল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দমকল থেকে পুলিশ। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দমকল মন্ত্রী সুজিত বসুও।
ইতিমধ্যেই গোটা ঘটনা প্রসঙ্গে কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হোটেলের নিরাপত্তা থেকে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন পুরোটাই গোলযোগ। আগুন নেভানোর ন্যূনতম ব্যবস্থা ছিল না ৬ নম্বর মদন মোহন বর্মন স্ট্রিটের ওই হোটেলে। পাওয়া যায়নি জল। এলাকার এক বাসিন্দা বলছেন, ওদের হোটেলে কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। দমকলের লোকজনই বলছে জলের লাইন করা আছে কিন্তু জল ছিল না। বহুতলে যে ট্যাঙ্ক থাকে সেখানে জল ছিল না। যে জল বের হচ্ছিল তাতেও সেরকম চাপ ছিল না। পুরো পাইপ লাইনই খালি। তাঁর কথায়, আগুন লাগার পর রিজার্ভার থেকে জল নিয়ে হোটেলের লোকজনই আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছিল। এখনও তো পাইপ লাগানোই আছে। কিন্তু, জল তো নেই। কী আর হবে! তারপর তো দমকল এসে লোকজনকে বাঁচাল।
মঙ্গলবার রাত ৮টা নাগাদ আগুন লেগে যায় বড়বাজারের মেছুয়ার মদন মোহন বর্মন স্ট্রিটে ছতলা 'ঋতুরাজ' হোটেলের দুই তলায়। চোখের নিমেষে ছড়িয়ে পড়ে আগুনে লেলিহান শিখা। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় চারপাশ। আগুনের গ্রাসে চলে যায় গোটা হোটেলটিই। আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে থাকেন হোটেলের আবাসিকরা। কেউ কেউ কার্নিসে ঝুলতে থাকেন। জানা যাচ্ছে বেরিয়ে আসার আপাতকালীন রাস্তা ছিল হোটেলে। খবর পেয়েই ছুটে আসে দমকল। দ্রুত বাড়তে থাকে দমকলের ইঞ্জিনের সংখ্যা। তারপর থেকে প্রায় ৮ ঘণ্টা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে চলে উদ্ধার কাজ। ভিতরের এতটাই খারাপ অবস্থা ছিল যে বেশ কিছু ব্যক্তিকে হোটেলের কার্নিশ দিয়ে বের হতে দেখা যায়। অনেকেই আতঙ্কে হোটেলের ছাদে উঠে যান। এদিকে হোটেলে রয়েছে মোট ৪২টি ঘর। সেখান থেকে অনেকেই প্রাণভয়ে ছাদে উঠে গিয়েছিলেন বলে দমকলের লোকজন জানাচ্ছেন। প্রায় ২৫ জনকে হাইড্রোলিক ল্যাডারের সাহায্যে নামানো হয়। অন্যদিকে ঘটনার পর থেকে হোটেলের মালিকেপ খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর খোঁজে তল্লাশি চলছে বলে জানান কলকাতার পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা।
দমকল মন্ত্রী সুজিত বসু জানান, “খবর পেয়ে আমরা ওখানে গিয়েছিলাম। হোটেল কর্তৃপক্ষের অনেক গাফিলতি ছিল। ওদের সিস্টেম কোনও কাজ করেনি। তার সঙ্গে পুরো বিল্ডিংটা গ্লাস দিয়ে ঢাকা ছিল। আগুন বা ধোঁয়া বের হওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না। সে কারণেই দমবন্ধ হয়ে লোকজন মারা গিয়েছে। আগুন নেভানোর সময় ভিতরে ঢুকে আমাদের লোকজনকে সেই কাচ ভাঙতে হয়েছে। হোটেলের বিরুদ্ধে আইনের দিক থেকে যা যা অ্যাকশন নেওয়ার সবটাই নেওয়া হবে।” প্রশ্ন তুলছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। তাঁরা বলছেন জলের যে ট্যাঙ্ক ছিল সেখান থেকে জল নিয়ে শুরুতে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে হোটেলের লোকজন। কিন্তু সেখানেও পর্যাপ্ত জল ছিল না।
যে রাস্তায় আগুন লেগেছে সেটি হল সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ এবং বিধান সরণির সংযোগকারী। এই রাস্তাটি তুলনামূলক ভাবে বেশ অনেকটাই ঘিঞ্জি। ফলে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। ঘটনাস্থলে ভোর ৩টে পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম, কলকাতার নগরপাল মনোজ বর্মা এবং রাজ্যের নারী ও শিশু কল্যাণ দফতরের মন্ত্রী শশী পাঁজা। ঘটনায় অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। এরই মধ্যে নিহতদের পরিবার পিছু ২ লক্ষ টাকা এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য মাথা পিছু ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে এই সাহায্য করার কথা জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে গোটা ঘটনায় অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। সোশ্যাল মাধ্যমে কটাক্ষের সুরে তিনি লিখেছেন, "১৫ বছর আগের স্টিফেন কোর্ট ট্র্যাজেডির স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে এ ঘটনা। যথাযথ অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব এবং অন্যান্য অবহেলার কারণে এই ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ঘটেছে। অথচ রাজ্য পুলিশ প্রশাসন দিঘায় ৩দিনের ছুটি কাটাতে ব্যস্ত!"