সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস 'দুই নারী, হাতে তরবারি'। যেখানে রয়েছে সম্পর্কের টানাপোড়েন। সুনীলবাবুর সেই বিখ্যাত উপন্যাসের নামটি একেবারে যেন যথার্থ কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে। নারদা মামলায় সিবিআই শোভনবাবুকে তুলে নিয়ে যেতেই যেভাবে তাঁর স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায় ও বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় লড়াই শুরু করেছেন তা এখন বাংলার মিডিয়ায় অন্যতম চর্চিত বিষয় হয়ে উঠেছে। আর সেইসঙ্গে ফের একবার লাইমলাইটে চলে এসেছে একদা রাজ্যের দমকলমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জীবন।
সোমবার শোভন গ্রেফতার হওয়ার পর সিবিআই দফতরে পৌঁছে যান স্ত্রী রত্না। গভীর রাতে শোভনকে নিজাম প্যালেস থেকে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যাওয়ার সময় সঙ্গে ছিলেন বান্ধবী বৈশাখী। শোভন চট্টোপাধ্যায়ের জন্য হাপুস নয়নে কাঁদতে দেখা গিয়েছিল বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাঁর জন্য নিজাম প্যালেসে বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল রত্না চট্টোপাধ্যায়কে। এই ছবি বাংলা খবরের চ্যানেলগুলির টিআরপি বাড়াচ্ছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সোপ অপেরা ছেড়ে অনেকেই এখন নিউজ চ্যানেলের রিমোট পাল্টাচ্ছেন শোভন-বৈশাখী আর রত্নার জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত দেখতে।
২০১৭ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা
২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগে প্রকাশ্যে এসেছিল নারদা স্ট্রিং অপারেশনের ভিডিও। যাতে অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন তৎকালীন কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। এরপর ২০১৭-র ১৬ নভেম্বর। সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে একটাই খবর, স্ত্রী রত্নার বিরুদ্ধে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করেন শোভন! এই ঘটনায় যতটা চমকেছিল আমজনতা, নোটিস হাতে পাওয়ার পর না কি ঠিক ততটাই অবাক হয়েছিলেন স্বয়ং রত্না চট্টোপাধ্যায়ও। স্ত্রী রত্নাদেবীর বিরুদ্ধে পারিবারিক হিংসা এবং নিষ্ঠুরতার একাধিক অভিযোগ আনেন শোভন। এরপরই শুরু হয় কাদা ছোড়াছুড়ি। বিতর্কের ঝড় ওঠে। আর এই ঘটনার সঙ্গেই উঠে আসে শোভন ঘনিষ্ঠ অধ্যাপিকা বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও। ইতিউতি শোনা যায়, বৈশাখীর সঙ্গে বন্ধুত্বের জন্যই নাকি স্ত্রীয়ের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল তৎকালীন কলকাতার মেয়রের। গুরুতর এই অভিযোগে কিছুটা হলেও সবুজ সঙ্কেত দেন রত্না চট্টোপাধ্যায়ও।
প্রায় ৪ বছর পর শোভনের পাশে রত্না
গত ৪ বছরে অনেককিছু দেখেছে বাংলার আম জনতা। ২০১৯ সালে মন্ত্রীত্ব ও মেয়র পদ ছাড়েন শোভন। তৃণমূল ছেড়ে যোগ দেন বিজেপিতে। সেই শোভনই বান্ধবী বৈশাখীকে নিয়ে একুশের নির্বাচনের আগেই গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। এক কথায় এখন কোনও রাজনৈতিক পরিচয় নেই শোভনের। অন্যদিকে স্ত্রী রত্না এবার স্বামীর ছেড়ে যাওয়া বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জিতে প্রথমবার বিধায়ক হয়েছেন। ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে খবর, এই চার বছরে শোভনের মুখোমুখি হননি রত্না। কিন্তু বরফ গলল বিপদের সময়। নারদ কাণ্ডে সিবিআই শোভনকে গ্রেফতার করতেই পুরনো রাগ পুষে রাখতে পারেনি রত্না।
রত্না-শোভন-বৈশাখীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক
সোমবার সকালে নারদ কাণ্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সিবিআইয়ের তরফে কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন মেয়র শোভনকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় নিজাম প্যালেসে। তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। খবর কানে পৌঁছনো মাত্রই তড়িঘড়ি নিজাম প্যালেসে পৌঁছন রত্না। গাড়ি থেকে নেমেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে দেখা যায় তাঁকে। সাম্প্রতিক অতীতে শোভন-রত্নাকে একে অপরের বিরুদ্ধে একাধিকবার আক্রমণ শানাতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু দুর্দিনে স্বামীর পাশে দাঁড়াতে ভরসার হাত বাড়িয়ে দিলেন সেই রত্নাই। রাখঢাক না করেই বেহালা পূর্বের বিধায়ক রত্নার সাফ বক্তব্য ছিল, “শোভনের জন্যই সিবিআই দফতরে ছুটে এসেছি। অন্য কোনও কারণ নেই। আইজীবী নিয়োগ করেছি, দেখা যাক কী হয়!” স্বামীর পাশে রয়েছেন জানিয়ে দেন রত্না। সেই সময় প্রশ্ন ওঠে বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোথায়? কিন্তু সোমবার রাতেই নাটকীয় দৃশ্য দেখা যায় প্রেসিডেন্সি জেলের বাইরে। রাত দেড়টা নাগাদ, জেলের নীল দরজায় হাত চাপড়ে তারস্বরে চিৎকার করতে দেখা যায় বৈশাখীকে।
হাসপাতালেও চলছে নাটক
মঙ্গলবার ভোরে অসুস্থ বোধ করায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শোভন চট্টোপাধ্যায়কে। আর তারপর থেকেই রটে যায়, এসএককেএম হাসপাতালের উডবার্ন ব্লকে শোভনের পাশের কেবিনে ভর্তি করা হয়েছে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। যদিও পুরো বিষয়টি গুজব বলে উড়িয়ে দেন বৈশাখী। তবে এটাও জানিয়ে দেন, তাঁর একমাত্র লক্ষ্য এখন শোভনকে বাড়ি ফেরানোর। তিনি আইনজীবীদেরার সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করছেন। তাই অসুস্থ হওয়ার ফুরসত তাঁর নেই। এদিকে বৈশাখীর মত শোভনকে দেখতে হাজির হয়েছেন রত্নাও। আর এই প্রেক্ষাপটে এবার রত্না চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর ছেলেমেয়েকে হাসপাতালে যাতে ঢুকতে না দেওয়া হয়, সে ব্যাপারে এসএসকেএম-এর সুপারকে চিঠি দিয়েছেন শোভনের আইনজীবী।
আইনজীবীকে দিয়ে শোভনের বার্তা
মঙ্গল, বুধবার শোভন-জায়া রত্নাদেবী হাসপাতালে গিয়ে স্বামীর স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেন, চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেন। তারপরই শোভনবাবুর তরফে আইনজীবী মারফত বার্তা পাঠানো হয়, তাঁর অনুমতি ছাড়া যেন কাউকে কেবিনে ঢুকতে না দেওয়া হয়। আইনজীবীর চিঠিতে লেখা রয়েছে, আলিপুর আদালতে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে রত্নার ডিভোর্সের মামলা চলছে। হাসপাতালে রত্না ও তাঁর সহযোগীরা গিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারেন। যার জেরে শোভনবাবুর টেনশন আরও বাড়তে পারে, তিনি আরও অসুস্থ হতে পারেন। এ নিয়ে রত্নাদেবীর পালটা প্রতিক্রিয়া আবার, “মামলা চললেও ডিভোর্স হয়নি এখনও, আমরা এখনও স্বামী-স্ত্রী। আমরাও পরিবারের লোক, যদি আমরা যেতে না পারি তবে বৈশাখী কেন শোভনের কেবিনে ঢুকবে? আমিও চিঠি দিয়ে ওর ঢোকা বন্ধ করার দাবি জানাব।”
শোভন চট্টোপাধ্যায় আর তাঁর জীবনে নেই। এ কথা আগে একাধিক বার বলেছিলেন রত্না চট্টোপাধ্যায়। দু’জনের বিবাহবিচ্ছেদের মামলা এখনও চলছে। রাজনীতি করার মতো পরিণত মানসিকতা রত্নার নেই, ভোটের আগে প্রকাশ্যে বলেছিলেন তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যাওয়া এবং পরে বিজেপি ছেড়ে দেওয়া শোভন। কিন্তু নীলবাড়ির লড়াইয়ে সেই রত্নাই বিপুল ভোটে শোভনের পুরনো গড় বেহালা পূর্বে জয়ী হয়েছেন। শপথ নেওয়ার পর রত্নার তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য ছিল , শোভন একা তৃণমূলে ফিরুন অথবা বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে, কোনও কিছুতেই তাঁর আপত্তি নেই। তবে নারদ মামলার উত্তেজনার মাঝে আরও একবার সেই পারিবারিক কোন্দল প্রকাশ্যে এসেছে। আদালতে যখন নারদ মামলার টানাপোড়েন তুঙ্গে উঠেছে, সেই সময়ে সামনে চলে এসেছে রত্না-শোভন-বৈশাখীর ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েনও। বেহালার পর্ণশ্রীর বাড়ি থেকে দক্ষিণ কলকাতার বহুতল হয়ে এখন এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডে শোভন চট্টোপাধ্যায় । সিবিআইয়ের হাতে বন্দি। অসুস্থ। জেল না বেল, তা নিয়ে আইনি যুদ্ধ চলছে। সেই যুদ্ধের মধ্যেই ফিরে এল পুরনো যুদ্ধ। সেই স্বামী-স্ত্রী-বান্ধবীর পুরনো দ্বন্দ্ব।