বিহারের রোহতাস, নালন্দা। এরাজ্যের হাওড়ার শিবপুর এবং হুগলির রিষড়া। রাম নবমীর মিছিল ঘিরে হিংসা ছড়িয়েছে। যা নিয়ে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তেজনা। বিজেপি ও তৃণমূল একে অপরকে দোষারোপ করছে। তবে এই হিংসায় কারও উপকার হচ্ছে না বলেই মত বিশিষ্ট সুরকার-গীতিকার ও প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ কবীর সুমনের। বাংলা.আজতক.ইন-এ জানালেন নিজের কথা। দিলেন একাধিক প্রশ্নের উত্তর।
প্রশ্ন : হাওড়া, রিষড়ায় যে হিংসার ছবি সামনে আসছে, সেটা নিয়ে কী বলবেন?
কবীর সুমন : খুবই দু:খজনক ও দুর্ভাগ্যজনক। এই ভাবেই তো দেশটা- রাজ্যটা উচ্ছন্নে গেল। আমার উৎসব যেন আর একজনের যন্ত্রণার কারণ না হয়।
প্রশ্ন : আপনার কী মনে হয় এর পিছনে কোনও রাজনৈতিক অভিসন্ধি আছে ?
কবীর সুমন : আমাদের রাজনীতিটা এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছি, অনেক দিন ধরে, আজ তার ফল ভুগতে হচ্ছে। এর দায় আমাদের সবার। হেমন্ত কারকারের কথা মনে আছে? যত বোমাবাজি হয়েছিল, মসজিদে আক্রমণ হয়েছিল বিভিন্ন জায়গায়, সেই সব ঘটনার যারা অভিযুক্ত সে যে ধর্মেরই হোক, তাদের সবাইকে ধরা হয়েছিল। হেমন্ত যাদের অভিযোগ করেছিলেন, তাদের সবাইকে ছেড়ে দিল এই সরকার। অথচ সেই হেমন্ত কারকারে অদ্ভুতভাবে মারা গেলেন। বলা হয়, তিনি জঙ্গিদের হাতে মারা যান। অথচ হেমন্ত কারকারে সব সময় বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরতেন। অথচ সেদিনই কেন পরলেন না, সেই প্রশ্ন আজও অজানা। মাঝপথে উনি গাড়ি পাল্টেছিলেন। তিনি সেদিন গাড়ি পাল্টাবেন, তা বিদেশি জঙ্গিরা কীভাবে জানলেন ? আমি ব্যোমকেশ, ফেলুদা পড়া বাঙালি, একজন বুড়ো মানুষ। আমার মনে এই প্রশ্নটা আসে বারবার, কেন-কীভাবে মারা গেলন সেই হেমন্ত সাহেব। ওঁর স্ত্রী-কে দিল্লি সরকার পুরস্কার দিতে চেয়েছিলেন। উনি কিন্তু নেননি। হেমন্ত এই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের প্রকৃত বন্ধু। কিন্তু তার কী পরিণতি হল দেখুন! ভাবতেও অবাক লাগে। এটাও কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমাদের দেশটা এখন তো এভাবেই চলছে। ভাবতেও ঘেন্না লাগে।
প্রশ্ন : দেশের অবস্থা নিয়ে আপনার আপত্তি কেন ?
কবীর সুমন : আপত্তি তো থাকবেই। আমাদের দেশ গান্ধীর দেশ। সেই গান্ধীকে যিনি হত্যা করলেন, তাঁর পুজো হচ্ছে ? এটা ভাবতেই কষ্ট হয় আমার। এই নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করে না। দেখে খারাপ লাগে। এমন তো দেশটা ছিল না। কোনওদিন কি আমরা বলতে পারব না যে, চলুন সবাই একসাথে থাকি, একটু ভালোভাবে বাঁচি?
প্রশ্ন : আপনিও তো এই আবেদন করতে পারতেন, মানুষকে এক জায়গায় আসার আহ্বান...
কবীর সুমন : কার সঙ্গে কথা বলব বলুন তো ? কারও যে কিছুতেই কিছু আসে যায় না। আমার বন্ধুরা সব মারা গেছে। আমি তো অসহায়। এখন আমি গান করি, সুর লাগাই। আমার তো এখন মনে হয়, আমার একটা ঈশ্বর-আল্লাহ আমার নেই। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না আমার পরমেশ্বর আছে, ঈশ্বর-আল্লাহ আছে। তারা থাকলে কি এই অবস্থা হত ? পরমেশ্বর থাকলে তো হাতজোড় করে ডাকতাম। বলতাম, এদের রক্ষা করো। এসব থামিয়ে দাও। কিন্তু, এটাও মনে হয়, তিনি কি আমার মতো সাধারণ লোকের কথা শুনতেন ? তবে একজন মহাত্মা গান্ধী থাকলে অন্তত এটা করতেন। আমরা তো করছি না। আমরা কি তাঁর মতো হতে পারি না ?
প্রশ্ন : আপনি কি নির্দিষ্ট ধর্মে এখন আর বিশ্বাস করেন না ?
কবীর সুমন : আমি এক সময় নিজেকে কমিউনিস্ট বলতাম। খুব গর্ববোধ করতাম। কিন্তু এখন আমি গান্ধীবাদী। আমি এখন প্রতি মুহূর্তে গান্ধীবাদী। আমি ভাবছিলাম, হাওড়ার সেই এলাকায় যাব। যেখানে এই হিংসা হয়েছে। কিন্তু আমি তো হাঁটতে পারি না। আমি তো একা নড়াচড়াও করতে পারি না সেভাবে। এখন তো পরনির্ভরশীল। তবে হাওড়ায় যেতে ইচ্ছে করছিল। ওখানে আমি বসে বলতে চাই, এটা কেন হচ্ছে? এত হিংসা করে আপনারা কী পেলেন? (বলেই কাঁদতে লাগলেন কবীর সুমন, তারপর কিছুক্ষণ থেমে ফের বলতে শুরু করলেন।) একজন শিশুকে চুমু খেয়ে, ফুলের ঘ্রাণ নিয়ে যে আনন্দ মেলে সেই আনন্দ কি পাওয়া গেল ? ধর্মের নামে এত হিংসা কেন ? আমরা তো এমন দেশ-রাজ্য চাইনি।
প্রশ্ন : আপনি বললেন, কোনও নির্দিষ্ট ধর্মে বিশ্বাস করেন না- এই উপলব্ধি আপনার কবে হল ?
কবীর সুমন : আমি অফিশিয়ালি মুসলিম। সচেতন ভাবে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ততই আমার বিশ্বাসে ফাটল ধরছে। ঈশ্বরের কী কান নেই ? মানুষ আর কত কাঁদলে ইশ্বর, পরমেশ্বর শুনতে পাবেন ? আমার আর ধর্মের প্রতি বিশ্বাস নেই। কোনও ধর্মের প্রতি বিশ্বাস নেই। কোনওকিছুতেই নেই। এটার জন্য যদি আমাকে কেউ মারে, ধরে, আক্রমণ করে-যে যার ইচ্ছে তাই করুক।
প্রশ্ন : আপনি মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়েছেন। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো সভ্যতার সংকটে বলেছেন, 'মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ', কী বলবেন ?
কবীর সুমন : কিন্তু মানুষকে বিশ্বাস করে আমরা কী পাচ্ছি ? এত হানাহানি-হিংসা ? আমাকে ক্ষমা করবেন। জার্মান ভাষায় একটা প্রবাদ আছে, 'আমার স্বাধীনতা সেখানেই শেষ যেখানে তোমার স্বাধীনতা শুরু।' বলুন তো আমরা কোথায় মানছি একথা! আমির খান, বিসমিল্লাহ খান তো এই বিভাজন করেননি।