Advertisement

৪৭-এর বন্দোবস্ত নয়, একাত্তরই বাংলাদেশের ঠিকানা

দেশ রাজনীতি ছেলের হাতের লাড্ডু না। কিংবা যেমন খুশি তেমন সাজ বা নাচের রঙ্গমঞ্চও নয়।  সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দণ্ডমুণ্ডের একজন হয়ে মাথামুণ্ডহীন বচন ছাড়লে  তার খেসারত হাতে হাতে যেমন দিতে হয়, তেমনি অনাগত কালেও কিছুটা জমা থাকে। তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে দায়িত্বে থাকা বেকুব কোনো ব্যক্তির বচনের বা কর্মের ভোগান্তিটা যায় দেশের মানুষের উপর দিয়ে। বাংলাদেশ সেরকম একটি ক্রান্তিকালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের খবরবাংলাদেশের খবর
Aajtak Bangla
  • কলকাতা ,
  • 04 May 2025,
  • अपडेटेड 1:56 PM IST

বাংলাদেশের দায়িত্বশীল নানা তরফ থেকে হামেশাই ১৯৪৭ এর রাজনৈতিক বন্দোবস্তে ফিরে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে । এই কথার দ্বারা আদতে উনারা কি বোঝাতে চান, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়।  যেমন ধরুন গতবছরের ১৬ ডিসেম্বর  বাংলাদেশের বিজয় দিবস উপলক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এক মানচিত্রে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গসহ উত্তরপূর্ব ভারতের অংশকে দেখিয়ে ১৯৪৭ এর রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ইঙ্গিত দিয়ে নিজের ফেসবুকে সেটা প্রকাশ করেছিলেন। এতে প্রতিবাদ জানিয়েছিল ভারতের কর্তৃপক্ষ। প্রশ্ন উঠেছিল নানা তরফ থেকে। এর কোনো ব্যাখ্যা বাংলাদেশের সরকারের তরফ থেকে কিংবা মাহফুজ আলমের পক্ষেও দেওয়া হয়নি। যদিও শেষতক মাহফুজের মুরোদে কুলায় নাই সেই মানচিত্র ফেইসবুকে রাখতে। তিনি বাধ্য হয়েছেন সেটা মুছে দিতে।

দেশ রাজনীতি ছেলের হাতের লাড্ডু না। কিংবা যেমন খুশি তেমন সাজ বা নাচের রঙ্গমঞ্চও নয়।  সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দণ্ডমুণ্ডের একজন হয়ে মাথামুণ্ডহীন বচন ছাড়লে  তার খেসারত হাতে হাতে যেমন দিতে হয়, তেমনি অনাগত কালেও কিছুটা জমা থাকে। তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে দায়িত্বে থাকা বেকুব কোনো ব্যক্তির বচনের বা কর্মের ভোগান্তিটা যায় দেশের মানুষের উপর দিয়ে। বাংলাদেশ সেরকম একটি ক্রান্তিকালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।

কতিপয় দুর্মুখো দায়িত্বশীল ব্যক্তির হঠকারী বয়ানের কার্যকরণের তত্ত্বতালাশের নিমিত্তে মোটাদাগের ১৯৪৭ এর রাজনৌতিক ঘটনাপর্বে একটু আলোকপাত করে নেয়া দরকার। আমরা জানি মাউন্ট ব্যাটেন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যবনিকাপাত কর্মযজ্ঞ সমাধার জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে এসেছিলেন। এই নিমিত্তে তিনি নানা তরফে দেনদরবার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অবিভক্ত বাংলার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শরৎ বোসসহ কয়েকজন নেতা বাংলাকে অখণ্ড রেখে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্যে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এই প্রচেষ্টার পক্ষে মাউন্ট ব্যাটেনের সম্মতি ছিল।  কিন্তু বাধ সেধেছিলেন খোদ মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরুসহ দিল্লিকেন্দ্রিক কংগ্রেসনেতৃবৃন্দ। শেষতক ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়ে পাকিস্তান এবং ভারত নামের দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হল ১৯৪৭ সালের আগস্টে। একই সঙ্গে অবিভক্ত বাংলাও দুই টুকরো হয়ে গেলো। এর এক টুকরো আজকের পশ্চিম বঙ্গ ভারতের সঙ্গের আর আরেক অংশ সেকালের পূর্ববাংলা আর আজকের বাংলাদেশ যুক্ত হয়ে গেলো পাকিস্তানের সঙ্গে। বাংলাদেশের উত্তর পূর্বের ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রয়ে গেল ভারতের সঙ্গে।

Advertisement

আরও পড়ুন

যারা ১৯৪৭ এর রাজনৈতিক বন্দোবস্তে ফিরে যাবার খায়েশ প্রকাশ করছেন তাদের উদ্দেশে দুটো ঐতিহাসিক চুক্তির প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে আসতে চাই।  এর একটি হচ্ছে ১৯৫০ সালে দিল্লিতে সম্পাদিত ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান স্বাক্ষরিত চুক্তি বা নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি। অন্যটি হচ্ছে ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বাক্ষরিত ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি।

লিয়াকত-নেহরু চুক্তি ছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি যেখানে শরণার্থীদের তাদের সম্পত্তি হস্তান্তরের জন্য ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, অপহৃত নারী এবং লুণ্ঠিত সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার, জোরপূর্বক ধর্মান্তর ঠেকানো  এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা ছিল।

১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যুদ্ধ এড়ানো এবং উভয় দেশের সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা। এই চুক্তিতে শরণার্থীদের জন্য ভিসা ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছিল এবং সীমান্ত পেরিয়ে শরণার্থীদের অবাধ যাতায়াত সীমিত করা হয়েছিল। উভয় দেশে সংখ্যালঘু কমিশন স্থাপন করা হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দশ লক্ষেরও বেশি শরণার্থী স্থানান্তরিত হয়েছিল ওই সময়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব, সহযোগিতা এবং শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। এটি ছিল ২৫ বছরের একটি চুক্তি যা ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এটি ছিল দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থাপনের ভিত্তি। অথচ এই চুক্তিটি বাংলাদেশের রাজনীতি ও সামরিক মহল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বিরোধিতা করার জন্য একটি অজুহাত হিসেবে ব্যহৃত হয়ে আসছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসনের উত্থান ঘটে। এর ফলে ভারতের সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে যায়। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির ফলে ১৯৭০ সালের আগে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে যাওয়া হিন্দু বা মুসলিম শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফিরে আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যুর বাংলাদেশ পাকিস্তানসহ মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী অন্যান্য দেশ, যেমন সৌদি আরব এবং চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ১৯৭৫ সালের পর, কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম বা উলফা এর মতো ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে তার ভূখণ্ডে অবস্থান নেওয়ার অনুমতি প্রদানের জন্য সমালোচিত হয়েছিল।  অন্যদিকে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে   সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়েও ভারতের তরফ থেকে সন্দেহ ছিল। এর বিপরীতে  বাংলাদেশর পক্ষ থেকে  অভিযোগ ছিল ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর বিদ্রোহকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। ফলস্বরূপ, ১৯৯৭ সালে এসে চুক্তির প্রথম মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি নবায়ন করা যায় নি। 
এ পর্যায়ে আমি পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের তথ্যের উপর আলোকপাত করতে চাই। ১৯৪৭ সালে দেশটিতে  হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল ৩০ শতাংশ। পাকিস্তানি আমলে ২৪ বছর পরে তা ২০ শতাংশে নেমে আসে। ১৯৭২ সালে রেকর্ড করা এই ২০ শতাংশ ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে পাঁচ দশক পরে এসে ৭ বা মতান্তরে ১১ শতাংশে নেমে আসে।

২০১৫ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বাক্ষরিত ভূমি সীমান্ত বা ছিটমহল চুক্তির পরে ভারতের কুচবিহার থেকে ১১টি পরিবারের ৫৬ জন মুসলিম বাংলাদেশ আসে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের পঞ্চগড়। নীলফামারী, কুড়িগ্রাম এবং লালমনিরহাট জেলার ছিটমহলগুলো থেকে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ২০১ টি পরিবারের ৯২১ জন ভারতে চলে যায়। এতে দেখা যায় বাংলাদেশ থেকে দেশান্তরি হবার প্রবণতা বরাবর বিদ্যমান।

Advertisement

২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার পর বাস্তবতার দিকে যদি আমরা ফিরে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সীমান্ত বন্ধ করে দেবার পরেও বড় একটি সংখ্যার মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতে দেশান্তরী হয়।  সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে   প্রকৃতপক্ষে নরেন্দ্র মোদী, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের মুখ এবং মুখোশ একসঙ্গে রক্ষা করার জন্য অনুগ্রহ দেখিয়েছেন। কেননা সীমান্ত খুলে দেওয়া হলে বাংলাদেশ থেকে দলে দলে সংখ্যালঘু মানুষের সীমান্ত  পারি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করার মাইলের পর মাইলের ছবি দুনিয়ার সংবাদমাধ্যমে ছাপা হতে থাকত। তাতে শান্তির নোবেলজয়ী  ইউনূসের ভাবমূর্তি গোল্লায় যেত, সত্য লুকোনোর কোনো পথ আর খোলা থাকত না।  
 
এহেন বাস্তবতার পরও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মাহফুজের মতো মন্ত্রিসভার সদস্যরা অথবা সরকারের পক্ষের কুশীলবদের কেউ কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনার পক্ষের ও ১৯৭১ এর জাতীয় তাৎপর্যের চেতনায় ঐতিহাসিক মাইলফলকগুলোকে অবমূল্যায়ন করছে অথবা বাতিল করার হীন অজুহাত দেখাচ্ছে। যারা এরকম বাস্তবতাবিবর্জিত হঠকারী বয়ান সামনে নিয়ে আসছেন তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যদি ১৯৪৭ রাজনৈতিক বন্দোবস্তে ফিরে যেতে চান এবং ১৯৭১কে আড়ালে রাখতে চান, তাহলে ১৯৫০ সালের নেহেরু-লিয়াকত চুক্তিতে নজর বুলিয়ে নিন আগেভাগে। এই চুক্তির আলোকে পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়া বাংলাদেশের সংখ্যালঘু মানুষদের প্রত্যাবর্তন, তাদের ভূমি ও সম্পত্তির অধিকার ফেরত দেবার ব্যাপারে আপনাদের  বক্তব্য ও অবস্থান খোলাসা করতে হবে।  আর সেটা যদি না পারেন, আঁতলামি আর হঠকারিতা বাদ  দিয়ে, বাড়তি বয়ান না ছেড়ে ১৯৭১ এর চেতনার স্বাধীন বাংলাদেশকে মেনে নিন।  বাংলাদেশের আখেরি মুক্তি এখানেই, শেষ ঠিকানাও তাই।

(বাক্যগঠন ও বানান অসম্পাদিত। এই প্রতিবেদনের যাবতীয় তথ্য ও পরিসংখ্যানের দায় লেখকের।)         

লেখক- আনিসুর রহমান, বাংলাদেশী-সুইডিশ কবি, নাট্যকার ও রাজনীতি বিশ্লেষক, সুইডিশ রাইটার্স ইউনিয়নের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য  

Read more!
Advertisement
Advertisement