Advertisement

Tourist Places in Kumaon: কুমায়ুন কেন গেলাম? হিমালয়ে হাওয়া বদল অথবা 'ভারতাত্মা'র খোঁজে...

যে পরিবেশের মধ্যে আমরা দিনরাতের প্রতিটি মূহূর্ত কাটাই বার বার দেখে তার আকর্ষণ যায় কমে। তখন নেমে আসে একঘেঁয়েমি জনিত ক্লান্তি। মন তখন খুঁজে বেড়ায় বৈচিত্র। এই বৈচিত্রের সন্ধানেই মানুষ ভ্রমণে যায়। কখনো দেশে, কখনো বিদেশে, কখনো বা পাড়ি দেয় নিরুদ্দেশে। আর বাঙালি স্বভাবত ভ্রমণপ্রেমী। আর সেই ধারা যে বইছে আমার রক্তেও গত কয়েক বছরে তা ভালই বুঝতে পেরেছি। পুজো মিটতেই মনটা কেবল ঘুরতে যাই, ঘুরতে যাই করছে, কিন্তু যাব কোথায়? শেষপর্যন্ত ঠিক হল উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুনে সপরিবারে যাওয়া যাক এবার। সেইমতো নভেম্বরে মাঝামাঝি টিকিট কাটা হল। ট্রেনে করে লালকুয়া জংশন সেখান থেকে গাড়ি করে নৈনিতাল।

দেবভূমি কুমায়ুন যেন মনের পরম শান্তিদেবভূমি কুমায়ুন যেন মনের পরম শান্তি
সুমনা সরকার
  • কলকাতা,
  • 01 Dec 2025,
  • अपडेटेड 5:12 PM IST

যে পরিবেশের মধ্যে আমরা দিনরাতের প্রতিটি মূহূর্ত কাটাই বার বার দেখে তার আকর্ষণ যায় কমে। তখন নেমে আসে একঘেঁয়েমি জনিত ক্লান্তি। মন তখন খুঁজে বেড়ায় বৈচিত্র। এই বৈচিত্রের সন্ধানেই মানুষ ভ্রমণে যায়। কখনো দেশে, কখনো বিদেশে, কখনো বা পাড়ি দেয় নিরুদ্দেশে। আর বাঙালি স্বভাবত ভ্রমণপ্রেমী। আর সেই ধারা যে বইছে আমার রক্তেও গত কয়েক বছরে তা ভালই বুঝতে পেরেছি। পুজো মিটতেই মনটা কেবল ঘুরতে যাই, ঘুরতে যাই করছে, কিন্তু যাব কোথায়? শেষপর্যন্ত ঠিক হল উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুনে সপরিবারে যাওয়া যাক এবার। সেইমতো নভেম্বরে মাঝামাঝি টিকিট কাটা হল। ট্রেনে করে লালকুয়া জংশন সেখান থেকে গাড়ি করে নৈনিতাল। 

নৈনিতাল ভ্রমণ

বাঙালির চেনা দার্জিলিংয়ের থেকে বেশ আলাদা নৈনিতাল। শুধু দার্জিলিং নয়, ভারতের অন্যান্য শৈলশহরের থেকে কোনও অংশে কম নয় নৈনিতাল। নৈনি লেককে ঘিরেই গড়ে উঠেছে গোটা শৈলশহর। প্রায় ২,০৮৪ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই হ্রদ এখানকার অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এই নৈনি লেকে আমর বোটিংও করেছিলাম।  নৈনি লেকের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে মল রোড। রাস্তা খুব সংকীর্ণ হলেও হাঁটতে খারাপ লাগবে না। মল রোডের উপরই ছোট ছোট স্ন্যাকসের দোকান পাবেন। মল রোড গিয়ে শেষ হয়েছে বড় বাজারে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের মোমবাতি এবং শীতবস্ত্র পাবেন। এই মল  রোডের উপর বাইক ও সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। বাইক ভাড়া করে ঘুরে নিতে পারেন নৈনিতালের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত। হ্রদের একদম উত্তর দিকে রয়েছে নয়না দেবীর মন্দির। এটি ভারতের ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে একটি। নয়না দেবীর মন্দির থেকে বেশ কিছুটা দূরে রয়েছে লাভারস পয়েন্ট ও টিফিন টপ। নয়না পিক, চয়না পিক কিংবা তুষারাবৃত ত্রিশূল, নন্দাকোট, নন্দাদেবী দেখতে হলে রোপওয়ে চেপে পৌঁছে যান স্নো ভিউ পয়েন্টে। এখান থেকে কুমায়নের প্যানোরমিক ভিউ দেখতে পাবেন। 

Advertisement

কুমায়ুনের এই অঞ্চলটি সাতটি লেক নিয়ে গঠিত। নৈনি লেক তারই অংশ। তাই নৈনিতাল বেড়াতে গেলে অবশ্যই ঘুরে দেখুন ভীমতাল, সাততাল, নাউকুচিয়াতাল, খুরপাতাল, মালয়াতাল, হরিশতাল এবং লোখাতাল। এর মধ্যে ভীমতাল ও সাততাল পর্যটকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। গাড়ি ভাড়া করে এক দিনেই ঘুরে নিতে পারেন এই সব অঞ্চলগুলো। নৈনিতালে দু'রাত কাটিয়ে এবার আমাদের পরবর্তী গন্তব্য উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ি গ্রাম কৌশানি। গান্ধীজি কৌশানিকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘দ্য সুইজ়ারল্যান্ড অফ ইন্ডিয়া’ বলে।

পরবর্তী সফর কৌশানি

কৌশানি শব্দটি এসেছে কুমায়নি শব্দ থেকে। কৌশানি থেকে ত্রিশূল শৃঙ্গের সৌন্দর্য্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। উত্তরবঙ্গে গিয়ে সবাই যেমন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে মুগ্ধ হন তেমনই কৌশানি থেকে দেখতে পাওয়া ত্রিশূল শৃঙ্গও সকলকে মুগ্ধ করবে। এখানকার আবহাওয়া সারা বছরই মনোরম। এই অঞ্চলের এক শ্রেণির মানুষ আজও সংস্কৃত ভাষায় কথা বলে থাকেন। পাহড়া, হ্রদ, আশ্রম মন্দিরে এই গ্রামটি পরিপূর্ণ। কৌশানি যাওয়ার পথে নিম করোলি বাবার আশ্রমও দেখেনিলাম আমরা। আরা রানীক্ষেত থেকে গোটা যাত্রাপথে আমাদের সঙ্গী হলেন যাকে দেখতে যাওয়া সেই হিমালয়। 

 মুন্সিয়ারির অভিজ্ঞতা

কৌশানির পর এবার চকৌরি হয়ে আমার যাব  মুন্সিয়ারি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, রোমাঞ্চকর রাস্তা আর পৌরাণিক কাহিনির খোঁজে যদি থাকেন, তাহলে উত্তরাখণ্ডের মুন্সিয়ারি সেরা। পিথোরাগড় জেলার কুমায়ন অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত এই মুন্সিয়ারি। উত্তরাখণ্ডের এই গ্রাম থেকে আপনি হিমালয়ের এক অন্য রূপ দেখতে পেতে পারেন। তিব্বতের প্রাচীন সল্ট রুটটিও গেছে এই গ্রাম ছুঁয়ে। তবে এই গ্রাম পৌঁছানোর জন্য পেরোতে হয় কালামুনি টপ। এই পাসের উচ্চতা প্রায় ৯০০০ মিটারেরও বেশি এবং সেই উচ্চতা থেকে উত্তরাখণ্ডের আর এক দৃশ্য ধরা দিতে পারে আপনার চোখে। তবে কালামুনি টপ যাওয়ার আগে মুন্সিয়ারির প্রায় ৩৫ কিলোমিটার আগে রয়েছে বিরথি জলপ্রপাত। ১২০ মিটার উচ্চ এই জলপ্রপাত পর্যটকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়।

কালামুনি থেকে মুন্সিয়ারির দিকে বাঁক নিতেই আলো ঝলমলে হিমালয় যখন সামনে এল মা হঠাৎ বলে বসলেন, 'ওই যে বসে আছেন মহাদেব।' মনে হল এত  কষ্ট করে মা-বাবাকে কুমায়ুন নিয়ে আসা পুরোপুরি সার্থক।  একবার এই গ্রামে পৌঁছে গেলে আপনি নন্দাদেবী, নন্দাকোট, রাজারম্ভার এবং পঞ্চচুল্লির মত শৃঙ্গের যে দৃশ্য দেখতে পাবেন, তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। গ্রাম হিসাবে বেশ শান্ত মুন্সিয়ারি। উত্তরাখণ্ডকে বলা হয় দেবভূমি। পুরাণে পাওয়া যায়, দেবতাদের বসবাসের জায়গা ছিল উত্তরাখন্ড। মুন্সিয়ারিও সেই পবিত্র দেবভূমির এক অংশ। স্বয়ং মহাকাব্য মহাভারতের যোগ রয়েছে মুন্সিয়ারির সঙ্গে। কথিত আছে, কুরুক্ষেত্র জয়ের পর শেষমেশ তাঁদের বংশধরদের হাতে রাজত্বের দায়িত্বভার তুলে দিয়ে পাণ্ডবেরা স্বর্গযাত্রার পথে রওনা হয়েছিলেন মুন্সিয়ারি থেকেই। তার আগে মর্ত্যে তাঁদের শেষ রান্না পান্ডবেরা করেছিলেন এখানকার পঞ্চচুল্লিতে। পাঁচ শৃঙ্গের জন্য এই হিমালয়ান রেঞ্জের নাম পঞ্চচুল্লি। মুন্সিয়ারি সৌন্দর্য দেখে এবার আমার যাব বিনসর। 

বিনসরে রাত্রিযাপন

এই বিনসর পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় দুটি কারণে- প্রথমত এখান থেকে হিমালয়ের একটি প্যানোরামিক দৃশ্য অন্বেষণ করা যায় এবং অন্য কারণ হল বিনসর বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। আলমোড়া থেকে যতই উত্তর-পূর্ব দিকে যাওয়া হয়, পঞ্চচুল্লির দৃশ্য ততই স্পষ্ট হতে থাকে। এরই এক ঝলক দেখা যায় বিনসর থেকেও। তবে শুধু পঞ্চচুল্লি নয়, এর সঙ্গে কেদারনাথ, চৌখাম্বা, ত্রিশূল, নন্দাদেবী, নন্দকোট, মীরাঘুঁটি, শিবলিংয়ের মনোরম দৃশ্য অন্বেষণ করা যায় বিনসর থেকে। এর জন্য যেতে হয় বিনসর জিরো পয়েন্টে। পক্ষী প্রেমীদের কাছে এই বিনসরের জঙ্গল স্বর্গোদ্যান। চিতাবাঘ, বন্য হরিণ, হিমালয়ান গোরাল, হিমালয়ের শিয়াল, দোয়েল, ম্যাগপাই, লাফিং থ্রাশ সহ নানা পশু পাখির বাস এই বিনসরের জঙ্গলে। তবে সন্ধ্যের বিনসর একটু অন্যরকম। ঝিঁ-ঝিঁর ডাক তো শোনা যায়ই, তার সঙ্গে নীচে আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে আলমোড়া শহর। ওপরে বসে সন্ধ্যের পাহাড়ি শহরের দৃশ্য এক অন্য অভিজ্ঞতা এনে দেয় জীবনে। তবুও থেমে থাকার জো নেই। কারণ ভোরের আলোর সঙ্গে এবার আমাদের ঘরে ফেরার পালা।

Advertisement

সফর শেষ

সফরের শেষদিন বিনসর থেকে আলমোড়া হয়ে আমার ফের রওনা দিলাম লালকুয়া জংশনের দিকে ট্রেন ধরতে। আলমোড়ায় পৌঁছে নাকি ঘণ্টা দুয়েক কথাই বলতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রাচীনত্বের গন্ধ মাখা এই ছোট্ট পার্বত্য জনপদের সৌন্দর্যে! লিখেছিলেন— ‘এই মাটিতে রইল তাহার বিস্মিত প্রণাম’। কুমায়ূন হিমালয়ের কোলে চির-দেবদারুর ছায়া আর মেঘ-কুয়াশায় মাখা এই শহরটির সৌন্দর্য দেখার জন্যই এখানে ছুটে আসেন পর্যটকেরা। শ্রীকান্ত, গঙ্গোত্রী, কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, শতোপন্থ, কামেথ, দ্রোণগিরি, নন্দাদেবী, ত্রিশূল, নন্দকোট, পঞ্চশূল— একই ফ্রেমে এতগুলি পর্বতশৃঙ্গের দেখা মেলে এই আলমোড়াতেই। গৌতম বুদ্ধ যেমন বুদ্ধগয়ায় বোধিবৃক্ষের নীচে বসে ধ্যান করে বুদ্ধত্ব অর্জন করেছিলেন। তেমন নরেন্দ্রনাথ থেকে আধ্যাত্মিক উন্মোচনের মাধ্যমে বিবেকানন্দ হয়ে ওঠার স্বামীজির জীবনের এই পর্বটি ঘটেছিল এই আলমোড়ায়, ১৮৯০ সালে। এরপর ১৮৯৮ সালে ভগিনী নিবেদিতা, ওলিবুল ও অন্যান্য কয়েকজনের সঙ্গে বিবেকানন্দ আলমোড়ায় আসেন। সেই ইতিহাস ছুঁয়ে দেখা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। কী করে যে ১০ দিন কেটে গেল, বুঝতেই পারলাম না। এই সফরে আমাদের সঙ্গী ছিল গোমতী, সরয়ূ, রামগঙ্গা এবং কোশী নদী। আধ্যাত্মিকতা থেকে অ্যাডভেঞ্চার, উত্তরাখণ্ডে পুরোটাই আমার প্রাপ্তিযোগ। এই  অভিজ্ঞতা সারাজীবন থেকে যাবে।


 

Read more!
Advertisement
Advertisement