Advertisement

'পুজোয় কলকাতার থেকে কম যেত না আসানসোল-দুর্গাপুর, সে যুগে ঘুগনিই ছিল বিরিয়ানি'

আর হ্যাঁ, সেই কলকাতাতে রাজকীয় ঢঙে দুর্গাপুজো হয়। লাখ লোক নাকি রাত জেগে ঠাকুর দেখে আবার কাছাকাছি জেলার লোকেরা সন্ধ্যাবেলায় শহরে ঢুকে সকালের ট্রেনে বাড়ি ফেরে। এসব গপ্পো আর ছবি পুজোর সময় খবরের কাগজে ঢাউস করে ছাপা হতো, দেখে মনে ঈষৎ উত্তেজনা হতো বটে তবে তা প্রশমিত করতে হতো তৎক্ষণাৎ, কারণ কলকাতায় পুজো দেখতে যাওয়া অত দূর থেকে তখন ভাবাও যেতনা।

ফাইল ছবি
Aajtak Bangla
  • কলকাতা,
  • 01 Oct 2022,
  • अपडेटेड 9:48 PM IST
  • 'পুজো আসছে' এই শব্দবন্ধটির প্রয়োগ প্রতি বছরের একটি অভ্যাস
  • হিন্দু বাঙালির মনটা তো কমবেশি আনচান করেই এটি শুনলে
  • সরি 'শুনলে' বলছি কেন, ওটাতো বাঙালি নিজেই নিজেকে শুনিয়ে দেয়

'পুজো আসছে' এই শব্দবন্ধটির প্রয়োগ প্রতি বছরের একটি অভ্যাস। হিন্দু বাঙালির মনটা তো কমবেশি আনচান করেই এটি শুনলে। সরি 'শুনলে' বলছি কেন, ওটাতো বাঙালি নিজেই নিজেকে শুনিয়ে দেয়। তবে হ্যাঁ মন আনচান করাটা অবশ্য বয়স, সঙ্গতি, পরিবেশ, পরিস্থিতি, অর্থনীতি ইত্যাদি অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। তবু পুজো সার্বজনীন। তাই ওটা ধমণীতে বয়। কম আর বেশি সে যাইহোক, একটু বয় বৈকি। 

বলে রাখা ভালো এই বছর কয়েক আগেও 'পুজো আসছে' শব্দটা 'শরৎকাল'টি আকাশের উপর ঢলে পড়লে বলা হতো, সাম্প্রতিক কালের মত পুজোর এক মাস আগেই ' পুজো লেগে গেছে' কালচারের ঢক্কানিনাদ ছিলোনা আগে । এখন তো জমজমাট উদ্বোধনের সংস্কৃতির চল হয়েছে। এবং সেটি মহালয়ার দিন থেকেই। তা হোক, আমি এই নিয়ে বলার কে ! মহালয়ায় চক্ষুদান হলেই মন্ডপের দরজা খুলে দিচ্ছেন অনেকে, কিছু মানুষ সেখানে যাচ্ছেন, ঢিপিস করে  প্রতিমা প্রণামও করছেন তবে আনন্দটা ঠিক তখন থেকেই গায়ে মাখছেন কিনা জানিনা। তবে পুজোর কাঠিটা বাজিয়ে দেওয়াটা শুরু হয়েছে। সে কাঠিতে বোল উঠুক আর না উঠুক, পুজোটা আগেভাগেই লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। 

তবে চিরটা কাল তো ওরকম ছিলোনা, পুজো ছিলো চার দিনের। তারপর ষষ্ঠীটাও জুড়লো, লোকে তাও মেনে নিলো কারণ চারের  জায়গায় পাঁচ হলে মন্দ কী ? ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী আর দশমীতে একটু আলাদা করে বাঁচার চেষ্টা বা একঘেয়েমি থেকে কিছুটা সরে যাওয়ার লিপ্সা তো মানুষের থাকেই। দুর্গাপুজো  সে সুযোগটা এনে দেয়। ব্যাস, ফূর্তি তখন ওড়ে, যে যার মতো করে তাকে ছুঁয়ে দেখে।

এই ছুঁয়ে দেখাটা অঞ্চলভেদে এক এক জায়গায় এক একরকম। মহানগর বা নগর তার ঔজ্জ্বল্য আর তার ঐতিহ্য নিয়ে পুজোর উৎসব পালন করে। আধা শহর তার মত করে আর গ্ৰাম বা পাড়া-গাঁ তার মত করে। পুজোর প্রাণ ভক্তি আর তার জৌলুস শক্তি। এখানে শক্তি মানে উন্মাদনা হতে পারে।

Advertisement

আমার শৈশব আর যৌবনের একটা সময় কেটেছে বরাকর নদের তীরে। মাইথন নামক এক জনপদে। সেটিকে ইংরেজি শব্দ 'টাউন' দিয়ে ঠিক ছোঁয়া যায়। বাঙলা আর অধুনা ঝাড়খন্ডের সীমান্তে পাহাড় আর নদী দিয়ে ঘেরা টাউন। মানুষের মূল জীবিকা চাকরি। দামোদর ঘাঁটি নিগমের জলবিদ্যুৎ তৈরী হয় সেখানে। যার যেমন যোগ্যতা বা পোস্ট তিনি তেমন মাইনাপত্তর পান তবে সেখানে দেখনদারী কম, মিলমিশ বেশি। ওটাই সংস্কৃতি, ওটাই ভালো থাকার পাসওয়ার্ড তখন। সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পুজো হতো খান দশেক। প্যান্ডেল তৈরীর বাঁশ পড়তো পাড়ার মাঠে পুজোর দিন পনেরো আগে আর পাড়ার দাদা, কাকু আর কয়েকজন হাফ্ পেশাদার মিস্ত্রী মিলে গর্ত খোঁড়া থেকে মন্ডপের ভিতরের কাপড়ের কুচি দিয়ে সাজানো মানে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সবই করতো। একটা একটা করে বাঁশ পোঁতা থেকে ছাউনি তৈরী হওয়া মানে পুজো আসছে। আমরা ছোটরা ওই বাঁশে দোল খেতাম ঠিক যেমন হাল্কা মেঘ শরতের আকাশে দোল খায়। কোনো কোনো মন্ডপে প্রতিমা তৈরী হতো আবার কোথাও বা প্রতিমা আনা হতো বিশ মাইল দূরের আসানসোল থেকে পুজোর দিন দুয়েক আগে। উত্তেজনার পারদ ছুটতো তখন তীর বেগে। সীমিত ক্ষমতা অনুযায়ী মানুষের নতুন জামা তৈরীর সাথে 'পুজোয় চাই বাটার জুতো' তখন পুজোর অনুষঙ্গ। ওই যেন 'বঙ্গ জীবনের অঙ্গ'র মত। আর ষষ্ঠী তখন 'মহাষষ্ঠী' হয়নি, তবে তা কিছুটা যেন পুজোর ঘোর আনতো। পুজো শুরু হতো সপ্তমীতে, আমার মত কম বয়সী ছানাপোনারা বাবা মায়ের হাত ধরে বা কৈশোরের বয়স ছুঁলে জনা পাঁচেক বন্ধু মিলে এ পাড়া, সে পাড়ায় বারবার পাক খাওয়াই ছিল পুজো। খুচরো পয়সায় জমাটি মেলায় ঘুগনিই ছিল তখন বিরিয়ানি। কার পাড়ার প্যান্ডেল ফার্স্ট হয়েছে আর কারটা সেকেন্ড নিজেরাই ঠিক করে নেওয়া দস্তুর ছিলো। তাতে তর্কাতর্কি ছিলো বটে তবে জনমতে একটা কিছু শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যেতো এবং সবাই সেটা মেনেও নিতো। আসলে সব পুজোই তখন নিজের পুজো। শুধু মা দুগ্গার  কৃপা পেলেই হলো। পুজো মানে কম্পিপিটিশন সেই কনসেপ্ট ছিলনা তখন, ছিল আবেগ মাখা হুড়োহুড়ি আর আনন্দের ফুলঝুরি। তবে তখন থেকেই কানে আসতো পুজো নিয়ে প্রতিযোগিতার কথা, এশিয়ান পেইন্টস্ তার পাওনিয়ার।  সেটি হতো কলকাতা শহরে মানে আমাদের বাসভূমি থেকে প্রায় দুশো মাইল দূরে কল্পনায় গাঁথা এক মহানগরে। যেখানে ইডেন গার্ডেনে টেস্ট খেলা হয়, বাঙলায় ধারাবিবরণী হয়ে তা আমাদের সবার বাড়িতে ঢোকে আর ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহামেডানের ফুটবলের মারাত্মক উত্তেজনার পারদ পাড়ায় আর ক্লাবে টগবগ করে ফুটতে থাকে। 

আর হ্যাঁ, সেই কলকাতাতে রাজকীয় ঢঙে দুর্গাপুজো হয়। লাখ লোক নাকি রাত জেগে ঠাকুর দেখে আবার কাছাকাছি জেলার লোকেরা সন্ধ্যাবেলায় শহরে ঢুকে সকালের ট্রেনে বাড়ি ফেরে। এসব গপ্পো আর ছবি পুজোর সময় খবরের কাগজে ঢাউস করে ছাপা হতো, দেখে মনে ঈষৎ উত্তেজনা হতো বটে তবে তা প্রশমিত করতে হতো তৎক্ষণাৎ, কারণ কলকাতায় পুজো দেখতে যাওয়া অত দূর থেকে তখন ভাবাও যেতনা। আর সারারাত ঠাকুর দেখা যে সম্ভব বা ওটা একটা পুজো কালচার সেটা ভাবাও কঠিন ছিলো তখন।  কারণ আমাদের ওখানে রাত্রি দশটা বা বড়জোর এগারোটা মানে সেদিনের মত পুজো শেষ। যা হবে আবার পরের দিন সকালে। এটাই স্বাভাবিক ছিলো, ওটাই ছিল হকিকৎ।

তা বলে কি দিন বদলায় না, দিন তো বদলায়ই। আমাদের ছোট্ট টাউন রাত এগারোটায় ঘুমোলেও  শোনা যেত নিকটবর্তী আসানসোল বা দুর্গাপুর নাকি পুজোর সময় রাতে ঘুমোয় না। তারাও জেগে থাকে কলকাতার মত। সেখানের পুজোর মেলাগুলো খোলা থাকে, ফুলৌরী, তেলেভাজা, ঘুগনি আর আলুকাবলী লোকে রাত গভীর হলেও চেটে চেটে খায়। বাচ্চারা রাতেও নাগরদোলায় ঘুরপাক খায় আর তাদের বাবা মায়েরা ওদের নিয়েই প্যান্ডেল হপিং করে। লাইন দিয়ে বা গোছা গোছা ভীড়ে গা ডুবিয়ে সবাই ঠাকুর দেখে, মানে শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুর কলকাতার পুজোকে টেক্কা দিতে নিজেকে ধীরে ধীরে বেশ গুছিয়ে নেয়। সরকারি, বেসরকারি নানান অফিস কাছাড়ী ও বড় বড় দোকানপাটের শহর দুর্গাপুর দুর্গাপুজোর ল্যান্ডমার্ক হয়ে উঠতে থাকে। বর্ধমানের পশ্চিমে  দুর্গাপুর বড় পুজোর আর হৈ হৈ-এর রমরমার কেন্দ্র  'এই বার্তাটি রটি গেলো ক্রমে'। আর রটে যখন গেছে তখন তাকে চাক্ষুস করার ইচ্ছেটাও জেগে গেছে আমাদের অনেকেরই। রাতে না ঘুমিয়ে ফোস্কা পড়া পায়ে ঠাকুর দর্শনের মহিমা যে কী সেটি হাতেনাতে বুঝে নেওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় তখন আমাদেরও দিন গোনা শুরু হলো। বয়সের পাখার স্বভাবই তাই, লুকোনো স্বপ্ন কে ছুঁয়ে দেখা চাই। 

Advertisement

রাতের শরতের মেঘকে সাক্ষী রেখে শিল্পাঞ্চলের শিল্প দর্শন করার জন্য দুর্গাপুজোয় দুর্গাপুর যাবো পুজোয় তখন ওটাই বাসনা। কিন্তু বাসনা আর রসনা পূর্তির একটা অলিখিত নিয়ম আছে। ওটা মনে মনে গাঁথতে হয়। ইঁটের পর ইঁট গেঁথে যেমন অট্টালিকা ওঠে, বাসনা আর রসনাও তাই। ওই ইঁটগুলো সাজাতে হয় ধীরে ধীরে। সেসব যখন জমাট বাঁধে তখন বাসনা পূরণের একটা সুযোগ কোথা থেকে হাজির হবে তা আগে থেকে বোঝা যায়না। ওটা সমাজ আর প্রকৃতি  নীরবে নীরবেই নিরূপণ করে দেয়। সমাজ আর সংসারের নিয়মই তাই। শুধু সুযোগটাকে চিনতে আর ধরতে পারলেই হলো। বলাবাহুল্য, হলোও তাই। হঠাৎ আমাদের মাইথনে খবর হলো, মাইথন থেকে বাস ছাড়বেন একজন পুজো অনুরাগী। সীট বুক করলে সপ্তমীর রাতে বাস ছুটবে আসানসোল হয়ে দুর্গাপুর। দুর্গাপুর প্রদক্ষিণ করে সেখানকার বড় পুজোগুলোয় ঢুঁ মারার সুযোগ হবে।  ঘুরে বেড়ানো যাবে দেদার আর কলকাতার ছায়াকেও কলকাতা না গিয়ে ছুঁয়ে দেখা যাবে। তখন মনেহলো- শুধু মেঘ চেয়েছিলাম, হাতে বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়লো টুপুস করে। তখনও পয়সা রোজগারের ক্ষমতা হয়নি তাই মা'র কাছে হাত পাততেই  বাসের  খরচ জুটে গেলো আর সপ্তমীর রাত ন'টায় মাইথন থেকে যখন বাস ছাড়লো তখন দুর্গাপুরই স্বপ্ন পূরণের ঠিকানা। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই বাস যখন ঢুকলো দুর্গাপুরে তখন মনেহলো ' কলকাতা ' না হলেও ওটা মিনি কলকাতা তো বটেই। সবাই সবাইকে টেক্কা দেওয়ার সংস্কৃতি তখন বাঙালির বেঁচে থাকার ডোমেনে ঢোকেনি, তাই ওই ভীড় যেন মনে হয়েছিলো আমার পাশের বাড়ি থেকে আসা মানুষের ভীড়। আনন্দ তখন সত্যিই যেন জমে ক্ষীর। 

এ পুজো থেকে সে পুজো কিছুটা বাসে আবার কিছুটা হেঁটে আমি ও আমরা যখন ঘুরছি তখন যেন কিছুটা অপু দুর্গার ট্রেন দেখার বিস্ময় ! সে কি বিরাট প্রতিমা, অঙ্গ সজ্জায় সুনিপুণ, মন্ডপের সাজে অবাক করা কারুকাজ। কলতান আর ঐকতানের আবহে দুর্গাপুরের দুর্গাপুজো তখন জমজমাট। অগ্ৰণী, নবারুণ, মামড়া বাজারের পুজো 'এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়।' আমি তখন নিজেকে দেখছি অন্য এক আলোয় ‌। মন্ডপের আলো যেন ঠিকরে পড়ে আমার অন্তরের অন্দরে। রাত বাড়ে তখন আরও রাত, গভীর রাত, কেয়াবাৎ, কেয়াবাৎ !

তারপর ভোরের আলোটা উঁকি দিতে শুরু করলো। বাস ছাড়লো আবার বাড়ির পথের দিকে। চোখ তখন কিছুটা ঢুলুঢুলু আমার। বাসের জানলা দিয়ে হাওয়া ঢুকছে যত, চোখ তখন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে তত। তাও আমি চেয়ে থাকার চেষ্টা করছি পথের দিকে, শরতের কাশফুল গুলো তখনও কেমন খেলছে, আর দুলছে। 

Advertisement

আসানসোল কোলিয়ারী অঞ্চলের পুজো ছুঁয়ে বরাকর নদের ব্রীজের উপর যখন আমাদের বাসের চাকা ছুঁলো, তখন আসলে সপ্তমীর পর মহাষ্টমীর বাজনা বেজে গেছে। ধীরে ধীরে আমার জন্মভূমিতে আমাদের বাসটি ঢুকলো, চকিতে বাস থেকে নেমে ছুটলাম বাড়ির দিকে। মা বললো- এবার জামাকাপড় ছেড়ে স্নান সেরে  মন্ডপে যাও। সেখানে ঢাক বাজছে। অঞ্জলী শুরু হবে। 

তখন যেন আমার মনে হলো, গতরাতের দুর্গাপুরের বড় পুজোর অঞ্জলী আর আমার পাড়ার ছোটো পুজোর অঞ্জলী এবার মিলেমিশে এক হয়ে যাবে। দুর্গাপুরের ঢাকের আওয়াজ মাইথনে এসে বোল তুলবে আর মাইথনের পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ দুর্গাপুর সহ  মহানগর কলকাতাতেও ছড়িয়ে যাবে।
একযোগে তখন চারিদিকে উচ্চারিত হবে- 
যা দেবী সর্বভূতেষু, মাতৃরূপেণ সংস্হিতা,
নমস্তসৈ নমস্তসৈ  নমস্তসৈ নমঃ নমঃ।

ইয়া দেবী সর্বভূতেষু ক্ষান্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।

Read more!
Advertisement

RECOMMENDED

Advertisement