Advertisement

Durga Puja 2023: সেই নন্দর সঙ্গে ৩০ বছর পর দেখা ঋষিকেশে, স্বামী ভৈরবানন্দ, হাতে রুপোর ত্রিশূল

এই ঘটনার তিরিশ বছর পর নন্দর সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল। হৃষিকেশে। গঙ্গার ঘাটে। হঠাৎই। গোঁফ-দাড়ির ফাঁকে আমি চিনতে পারিনি ওকে। নন্দই চিনেছিল।

পুজোর গপ্পোপুজোর গপ্পো
Aajtak Bangla
  • কলকাতা,
  • 10 Oct 2023,
  • अपडेटेड 10:16 AM IST

আশির দশকের প্রথমদিকে আমাদের দক্ষিণ শহরতলি তখনও দক্ষিণ কলকাতা হয়ে ওঠেনি। মফঃস্বলের গন্ধ ছড়িয়ে থাকত আমাদের বেলতলার মাঠে, কালো পিচের আঁকাবাঁকা রাস্তায়, বোসেদের পুকুরপাড়ে। তখনও রাসবিহারী কানেক্টার তৈরি হয়নি। বাস ধরতে হলে বালিগঞ্জের রেল লাইন পেরিয়ে যেতে হত ওপারে। যেন শহরটাই শুরু হচ্ছে ওদিক থেকে। এদিকে যারা থাকে, তারা যেন লুকোচুরি খেলার এলেবেলে।

তা সে যাই হোক, আমরা কিন্তু বাবা বেশ ছিলুম সেই সবুজ মাঠ, কচুরিপানা ভর্তি পুকুর আর একটু বোকাসোকা সহজ-সরল মানুষজন নিয়ে। সে বারের পুজোর কথা বলছি, সে বারেই প্রথম আমরা একা একা পাড়ার ঠাকুর দেখতে যাবার অনুমতি পেয়েছি। আমরা তখন ক্লাস ফাইভ সিক্স।

বোসেদের বড় পুকুরের ঠিক উল্টোদিকে ঘোষেদের পুকুর। দুটো পুকুরের মাঝখান দিয়ে সোজা চলে গেছে রাস্তা। ডানদিকে শীতলা মন্দির, পাশে সাধারণ পাঠাগার। মন্দিরের সামনেই ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। দুদিন আগেই নাকি ঠাকুর এসে গেছে, নন্দ বলেছিল। নন্দ বড়পুকুরের ধারে হলুদ দোতলা বাড়িটায় থাকে। আমাদের ইশকুলেই পড়ে, আমার এক ক্লাস নিচে কিন্তু মোটেই আমাকে দাদা বলে না। শরৎকাল তখন আশ্বিন মাসেই আসত, পুজোর একটু আগে। বিশ্বকর্মা পুজোর পর থেকেই আকাশটা কেমন যেন চকচক করত,একটু যেন বেশি নীল। সে বার পুজো বেশ দেরীতে অক্টোবরের শেষের দিকে। নন্দর কথা শুনে সপ্তমীর ভোরে যখন চুপিচুপি ঠাকুর দেখতে গেছি, বাতাসে তখন হেমন্ত... শীত শীত করছে। দেখি মন্ডপের সামনেটা ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। তারই দু-একটা ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাসন্তী রঙের দুমা মা, সবুজ রঙের অসুর, গোলাপি রঙের পেট-ওয়ালা গণেশ ঠাকুর। কারও হাতে কোনও অস্ত্র নেই, সাজগোজও বাকি মনে হল।

আরও পড়ুন

একটু পরে নন্দও এসে গেল, সঙ্গে আরও তিন-চারজন ছেলে। বেপাড়ার। আমি নন্দকে আড়ালে ডেকে বললাম, 'এরা কারা রে?' নন্দ বলল,'বকুলতলার। আমাদের ঠাকুরের সাজগোজ দেখতে এসেছে।'

Advertisement

এমন সময়, মস্ত একটা বস্তা নিয়ে তোৎলা হরি প্যান্ডেলে ঢুকে পড়েছে। পেছন পেছন ছোট ঠাকুরমশাই। আমরা ছেলের দল হই হই করে উঠেছি। নন্দ কানের কাছে মুখ এনে বলল,'এবার সাজানো হবে। মা দুর্গার অস্ত্র-সস্ত্র দেওয়া হবে হাতে হাতে।' হরিকে বললুম,' ও হরিদা, কী হবে গো এখন? 'অস্তর দে-দে-দেওয়া হবে। যা তোরা। ভা-ভা-ভাগ...', রেগে গেলে হরিদা বেশি তোৎলায়। নন্দ বলল,'এই শোন্, এবার বিজয়ার পর আমরা মা দুগ্গার অস্ত্র নেবো!

—'কী করে নেবো! ওতো বড় ঠাকুর, হাত অবধি আমাদের হাতই পৌঁছবে না! তার ওপর বড়োরা কেউ জানতে পারলে?'

সন্টু বলে বকুলতলার ছেলেটা বলল, 'ধূর!, মায়ের অস্ত্র তো দশমীর বরণের পর যে কেউ নিতে পারে! আমাদের পাড়ার পুজোতেও নেয়। দেখিসনি কতো লোক বাড়িতে মা কালীর খাঁড়া, মা দুগ্গার ত্রিশূল রেখে দেয়।' আমি বোকার মতো ফস্ করে বলে বসলুম- 'কেন রে?' নন্দ বলল, 'চোর- ডাকাতরা ভয় পায়!'

সন্টু বলল, 'না রে, এসব টিনের তৈরি, চোর ডাকাত কখনও এসবে ভয় পায়! ততক্ষণে সত্যি সত্যি হরি বড় চটের বস্তাটা খুলে ফেলেছে। চকচকে রূপোলি রঙের কতরকমের অস্ত্র! সন্টু ছোট ঠাকুরকে জিগ্গেস করল,'ঠাকুরমশাই,ওই চ্যাপ্টা গোল মতো অস্ত্রটার নাম কী গো? ঠাকুরমশাই মুচকি হেসে বললেন, ' চক্র, সুদর্শন চক্র! নারায়ণ বিষ্ণু দিয়েছিলেন মাকে।' নন্দ খঞ্জনির মতো একটা অস্ত্র দেখিয়ে বলল,'আর এটা কী গো?'

- ওটা বজ্র। ইন্দ্ৰ দিয়েছিল। আর ওই যে ঘণ্টার মতো জিনিসটা দেখছ, ওইটি ঐরাবত দিয়েছিল মাকে।' সন্টু বলল, 'আর ওই পদ্মফুলের মতো অস্ত্রটা?'

 'ওটা পদ্মফুলই। ব্রম্ভার দেওয়া। শুভ শক্তির বার্তা।'

আমি বললুম—' আর ত্রিশূল?'

ছোটঠাকুর বললেন—' ওটা স্বয়- মহাদেব দিয়েছেন মাকে। তোমরা এখন ছোট তো,সব কিছুর মানে বুঝবে না। মায়ের সব অস্ত্রের পৌরাণিক ব্যাখ্যা আছে।'

- বলুন না একটু... -

- এই যে ত্রিশূল— এর তিনটে ফলা— মানুষের তিনটে গুণ। সত্ত্ব,তমঃ,রজঃ – এটা দিয়েই অসুরকে বধ করেন মা।'

নন্দ আবার কানের কাছে ফিস্ ফিস্ করে উঠল।' ব্যাস্‌, এই অস্ত্রটাই আমার চাই, সেরা অস্ত্র।' হরিদা এবার খেঁকিয়ে উঠল— ' যা তোরা...ভাগ এবার। বিকেলে আসিস... সা সা সাজানো কমপিলিট হয়ে যাবে।' কথা না বাড়িয়ে আমরা কেটে পড়লুম তখনকার মতো। নন্দ আবার বলল, 'ত্রিশূলটা কিন্তু আমার চাই।' আমার কিন্তু বজ্র অস্ত্রটা খুব পছন্দ হয়েছিল। আকাশের বাজ যে মা দুগ্গার অস্ত্র হতে পারে, ভাবিনি কোনওদিন! নন্দ ত্রিশূল নেবে নিক, আমার বজ্র চাই.....

ঝড়ের মতো কেটে গেল পুজো। ষষ্ঠীতে কলাবউ স্নান, সপ্তমীতে নতুন জামা-কাপড় পরে এপাড়া ওপাড়া ঘোরা। অষ্টমী সকালে অঞ্জলি, নবমীতে ধুনুচি নাচ। দশমী সকালে নন্দ এসে হাজির বাড়িতে।

শোন...বরণ হয়ে গেলেই ত্রিশূলটা নিয়ে নিতে হবে !

আমি বললুম,-' কাকুরা যদি বকে? অতো বড় একটা অস্ত্র, মা দু-হাত দিয়ে ধরে আছে! তার থেকে ছোটখাটো কোনও একটা কিছু নিলে হতো না! গণেশের হাতে একটা সুন্দর গদা আছে দেখেছিস?

নন্দ বলল,- ' ধ্যুস্‌! অস্ত্র মানে শুধু ত্রিশূল! শোন, আমার একটা প্ল্যান আছে... বরণের পর ঠাকুর যখন লরিতে তোলা
হবে তখনই চেষ্টা করতে হবে।

- হাত পাবি? কেউ কিছু বলবে না?'
— ' না রে বাবা। অস্ত্র সবাই নেয়। নদীতেই তো সব ভাসিয়ে দেবে,আমাদের কাছে থাকলে তবু থেকে যাবে।' -

তারপর সন্ধেবেলা বরণ শুরু হল। ঠাকুরদের মুখে মুখে সন্দেশ দিতে শুরু করল পাড়ার কাকিমা-বৌদিরা। সিঁদুরে সিঁদুর পুজো মন্ডপ....
আমরা ছোটোরা গেছি সব ঠাকুরকে প্রণাম করতে। নন্দর দেখা নেই। বরণ শেষের দিকে। মা দুগ্গা,তার ছেলে মেয়ে তো বটেই, অসুর, সিংহ,ইঁদুর,পেঁচা, হাঁস – সবাইকে টপাটপ নমস্কার ক'রে ফেলেছি। লরি এসে গেছে। দুটো। একটায় মা একা যাবে, অন্যটায় চার ছেলে-মেয়ে।

Advertisement

বজ্র পেয়েছিলাম আমি। গাড়িতে ওঠার আগে অবধি দেখেছি ত্রিশূল মায়ের হাতেই। নন্দ গেল কোথায়! পায়ে পায়ে ওর বাড়ির দিকে এগোলাম। ওমাঃ, গিয়ে দেখি কেউ কোথাও নেই। সদর দরজায় তালা!


পরে জেনেছিলাম, দশমীর বিকেলেই নন্দর বাবা মারা যান। একমাসের মধ্যে ওরা বাড়ি বিক্রি করে পাকাপাকি ভাবে বেনারস চলে যায়, ওর মামারবাড়িতে।


এই ঘটনার তিরিশ বছর পর নন্দর সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল। হৃষিকেশে। গঙ্গার ঘাটে। হঠাৎই। গোঁফ-দাড়ির ফাঁকে আমি চিনতে পারিনি ওকে। নন্দই চিনেছিল।


– বোস ব্যাটা। ঠিক চিনেছি। এখানে আমাকে সবাই ভৈরবানন্দ বলে ডাকে। ওই পাহাড়ের ওপর আমার আশ্রম। কাল আসিস।

আমি কিছুটা ধাতস্ত হয়ে নন্দর দিকে তাকিয়ে দেখি। সাধু ভৈরবানন্দ। জটাজুট, রুদ্রাক্ষের মালা.... ডান হাতে একটা রুপোর ত্রিশূল....চক্ মক্ করছে— সত্ব,তমঃ, রজঃ.....

Read more!
Advertisement
Advertisement