এক।।
বাঁধের উপর ঘর। রাত নিঝুম হলে শিয়রে জল ছলাৎ ছলাৎ করে। জোয়ারে নদী বাঁধের কোলে আছড়ায়। কিছুতেই ঘুম আসে না সাকিনার। বাঁশ আর প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ঝুপড়ি দিয়ে উঁকি দেয় চাঁদের আলো। রাতচরা পাখি ডাকে। সাকিনা কান পেতে শোনে দূর থেকে আসা ঢাকের বাদ্যি। হিঁদুদের দুর্গা পুজোর মণ্ডপে ঢাক বাজছে। এখন খুব একটা বড় নয় তাদের দ্বীপ। খ্যাপা নদীর জলের ছোবলে ভাঙতে ভাঙতে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে ঘোড়ামারা। সাগর দ্বীপ আর আগুনমারির চরের মাঝখানের দ্বীপটি ঘোড়ামারা। হলদিয়া বন্দরের দিকে জলের ঢল বজায় রাখতে মাঝ নদীতে দেওয়াল দিয়েছে সরকার। সেই দেওয়ালে ধাক্কা খাওয়া জল আগুনমারির চরে আবার ধাক্কা খেয়ে ঘোড়ামারার দিকে ঝাঁপায়। খুবলে নেয় মাটি। নদীর ধারে দাঁড়ালে শোনা যায় ঝপাস.... ঝপাস.... ভেঙে পড়ছে মাটি। ভেঙে পড়ছে দ্বীপের মানুষের ভিটে মাটি, ঘর সংসার। মানুষের আশ্রয় হয় বাঁধের উপর। ঝুপড়িতে। এক ঝুপড়িতে সপরিবার। ব্যক্তিগত জীবনের আড়াল আবডাল অলীক এখানে। তবু ভাঙনের দ্বীপে শরৎ আসে। কাশ ফুল ফোটে। সাকিনাদের ইদের আগে পরেই হয় হিঁদুদের দুর্গা পুজো। সাকিনার বেশ লাগে মা দুর্গাকে। উচ্চমাধ্যমিক পাশ সাকিনার মনে হয় সব মেয়েই যদি দেবী দুর্গার মতো শক্তির অধিকারিণী হত! সব অশুভকে নিকেশ করতে পারতো! এ ছাড়াও সাকিনার মা দুর্গাকে ভালো লাগার আরও কারণ আছে। মা কেমন ছেলে মেয়ে সবাইকে নিয়ে বাপের বাড়ি আসে। এই পৃথিবী যে দুর্গার বাপের বাড়ি সেটা সাকিনা শুনেছে তার বন্ধু স্বপ্নার কাছে। হ্যাঁ, সাকিনাদের দ্বীপে হিন্দু-মুসলমানে কোনও রেষারেষি নেই, মারদাঙ্গা নেই। রাজনৈতিক দলাদলি ছাড়া প্রকৃতির মারে বিপর্যস্তত মানুষগুলো একে অন্যের হাত ধরে থাকে।ইদ-দুর্গাপুজো-মহরম-কালীপুজোয় সবাই এক সঙ্গে আনন্দ করে। দেওয়ালির রাত আর শবেবরাতের রাতে বাজি ফাটে। সাকিনা প্রতিবছর দুর্গা ঠাকুর দেখতে যায়। তার জ্যাঠা সোলেমান মিয়াঁ খুব নিষ্ঠাবান মুসলমান। কিন্তু কোনও দিন সাকিনাকে ঠাকুর দেখতে যেতে বারণ করেননি। বরং মজা করে গান গেয়েছে দু' কলি, 'এ কী দুগগি দেখলাম চাচা/ এ কী দুগগি দেখলাম নানি....।' সাকিনা জ্যাঠাকে বারণ করেছে এমন গান গাইতে। হিন্দুরা দু:খ পাবে। সোলেমান মিয়াঁ হেসে বলেছে, "দুর পাগলি, এটা একটা বিখ্যাত গান। রেডিওতে কত শুনেছি। বিষ্ণুপদ দাসের গলায় গানটা খুব দিত।"
এই সব ভাবতে ভাবতে রাত গভীর হয়। ঢাকের বাদ্যি থেমে গেছে অনেক ক্ষণ। সাকিনা ভাবে কাল সক্কালে সে পুজো মণ্ডপে যাবে। স্বপ্নাকে কথা দেওয়া আছে। কাল ভোর বেলা কলাগাছকে নদীতে স্নান করিয়ে মেয়েদের মতো লাল পাড় কোরা শাড়ি পরানো হবে। স্বপ্নারা বলে কলাবৌ। সত্যি ঘোমটা টানা বউয়ের মতো লাগে। সাকিনা ঠিক করে কাল ভোরে স্বপ্নার পাশে দাঁড়িয়ে সে নদী আর কলাবৌয়ের কাছে দোয়া করবে, তাদের দ্বীপ যেন আর না ভাঙে। এর পর ভাঙলে কোথায় যাবে তারা! কিন্তু সাকিনার মনে সংশয়, মুসলামন মেয়ের দোয়া কি হিন্দুদের ঠাকুর শুনবে? এক খানা গান সে প্রায় শোনে সোলেমান জ্যাঠার মুখে, 'আলির উপর কালী না কালীর উপর আলি / বল খোদা বল খোদা বল......।' এই সব ভাবতে ভাবতেই ঘুম নামে সাকিনার চোখে।
দুই।।
উদ্দাম বেজে ওঠে জয়ঢাক। তার মধ্যেই ঘ্যাঁচ করে একটা আওয়াজ হয়। এক কোপে মহিষের মুণ্ডুটা আলাদা হয়ে যায় ধড় থেকে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। চোখ বুজে ফেলে বুধমণি সোরেন। এই প্রথম সে ইচা গ্রামের দুর্গা পুজো দেখতে এসেছে। সে সাবেক মানভূমের সাঁওতাল মেয়ে। এখন তার জেলার নাম পূর্ব সিংভূম। তার পিসি ভালোবেসে বিয়ে করেছে পশ্চিম সিংভূমের হো ছেলে লেদাম বোদরাকে। টাটা-চাইবাসা রাস্তা থেকে একটু ভিতরে কুজু নদীর ধারে ইচা গ্রামে পিসির বাড়ি বেড়াতে এসেছে বুধমণি। ইচার দুর্গা পুজোর বেশ নাম ডাক আছে।
পাহাড়ি নদী কুজু। তার পাশে একটা টিলা পেরিয়ে ইচা। জনজাতি গ্রাম। সাঁওতাল, মুণ্ডা, হো সবাই আছে। কিছু ঘর মাহাতোও আছে। এই গ্রামের রাজারা দুর্গা পুজো করত। নামেই রাজা, আদতে জমিদার। তা সেই রাজাদের দুর্গাপুজোর রকম সকমে চাইবাসা বা জামশেদপুরে দেখা দুর্গা পুজোর থেকে আলাদা। বুধমণি অনেক পুজো দেখেছে ওই দুই শহরে। বাঙালিদের পুজো, ওড়িয়াদের পুজো, বিহারিদের পুজো। সেখানে দেবীর মুখ কোথাও পেলব, কোথাও ডাগর চোখে বীরত্ব, কোথাও স্নেহময়ী মাতৃ ভাব। কিন্তু ইচা গ্রামের রাজাদের উপাস্য দুর্গার মুখে একটা আদিম ভাব আছে। চোখ বেশ খর। এক সময়ে যে পুজো ছিল রাজাদের, আজ তা গ্রামের সর্বজনীন। কারণ রাজাদের কাল গিয়েছে। তবে গ্রামের মানুষ চেষ্টা করে পুজোর প্রাচীন রীতি নীতি ধরে রাখতে। তারই অঙ্গ মহানবমীর দুপুরে মহিষ বলি। মহিষের মুণ্ডু ও এক সরা রক্ত দেবীকে নিবেদন করে আবেগাপ্লুত হয়ে মন্ত্র পড়ছে পুরোহিত। না, পশুবধে কাতর হয়ে পড়ে না বুধমণি। সে নিজে হাতে একাধিক বার মুর্গি কেটেছে, গ্রামে পাঁঠা বা শুয়োর কাটা হতে দেখেছে। অস্বাভাবিক লাগেনি। কিন্তু মহিষের মতো বড় প্রাণী বধ হতে প্রথম দেখলো। তাই মহিষ বলির এই দৃশ্যে সে চোখ বুজে ফেলল। মহিষের মুণ্ডু ছিন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জয়ঢাকের উল্লাস ও ভক্তদের উন্মাদনা মিলে মহিষ বলির পরিবেশটাই কেমন ভয়াবহ হয়ে উঠল। কিন্তু সবাই মগ্ন ভয়হারিনী দেবীর বন্দনায়।
বুধমণির গ্রাম শালবনি। সুবর্ণরেখার ধারে ছায়াময় তাদের গাঁ। নীল আকাশে মেঘের ভেলা ভাসলে, রোদ্দুর নরম হলে, সুবর্ণরেখার ধারে কাশ ফুল ফুটলে বুধমণি বুঝতে পারে দুর্গা পুজো আসছে। জামশেদপুরের সাকচি বাজারে ভিড় উপচে পড়লে বুধমণি বুঝতে পারে দুর্গা পুজো আসছে। গ্রামের ছেলেরা দাশাই নাচের প্রস্তুতি শুরু করলে বুধমণি বুঝতে পারে দুর্গাপুজো আসছে।
বুধমণি সাঁওতালি ভাষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। অন্যের সংস্কৃতিকে সম্মান করা বা তাতে অংশ নেওয়ায় কোনও দোষ দেখেনা বুধমণি। কিন্তু নিজের সংস্কৃতিকে প্রাণাধিক ভালোবাসে। বুধমণি জানে দুর্গার হাতে মহিষাসুরের মৃত্যু আদতে আর্যদের হাতে অনার্যদের পরাজয়ের প্রতীক। তাই মহিষাসুর বধ অনার্য জনজাতির মানুষের কাছে শোকাবহ ঘটনা। সেই শোকেরই প্রকাশ দাশাই নাচ। মহিষাসুরকে আদিবাসীরা স্বজন বলে মনে করে। অসুর নামে জনজাতিও রয়েছে দেশে। সাঁওতাল জনজাতির বিশ্বাস এই ভূমিতেই ছিল তাদের আদি দেশ চাইচম্পা। সেখানকার রাজা ছিলেন হুদুড় দুর্গা। তাদের প্রবল শক্তিশালী সেই রাজার সঙ্গে লড়াইয়ে এঁটে উঠতে না পেরে বহিরাগতরা ষড়যন্ত্র করে। ছল করে তাদের ঘরের একটি মেয়ের সঙ্গে চাইচম্পার রাজা হুদুড় দুর্গার বিয়ে দেয়। চাইচম্পার মানুষ অর্থাৎ খেরওয়াল জাতির মানুষের কাছে নারী ছিল অবধ্য। সেই সুযোগ নিয়ে নব বিবাহিত বধূ রাজা হুদুড় দুর্গাকে খুন করে। তার পরেই বহিরাগতদের সঙ্গে যুদ্ধে খেরওয়ালরা পরাজিত হয়। রাজা হুদুড় দুর্গা বধের সঙ্গে মহিষাসুর বধের মিল আছে। দুর্গাপুজোর সময় সাঁওতাল গ্রামে হুদুড় দুর্গার পুজো হয়। দুর্গাপুজোর ঠিক আগের প্রতিপদ থেকে দুর্গাপুজোর দশমী পর্যন্ত দাশাই নাচ চলে। একদা চাইচম্পা রাজ্যে যে দাশাই নাচ ছিল আনন্দের প্রকাশ, হুদুড় দুর্গা বধের পর সেই দাশাই নাচ হয়ে উঠল শোকের প্রকাশ। পুরুষরা শাড়িকে বা পনছিকে কোঁচা দিয়ে পরে ও মাথার পাগড়িতে ময়ূরের পালকের গোছা বেঁধে বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যের সঙ্গে নাচে। দাশাই নাচের দল প্রতিপদে সেই যে বেরলো, ঘরে ফিরবে দশমীর দিন। বুধমণির দুর্গা পুজো মানে দাশাই নাচও।
ইচার পুজোয় মহিষ বলির উল্লাস থেকে সরে এসেছিল বুধমণি। পরে সন্ধ্যারতির সময় বুধমণি আবার গিয়ে দাঁড়ালো আদিম আদলের দুর্গা প্রতিমার সামনে। অনেক ক্ষণ দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে বুধমণির মনে হল এই দেবী কল্পনাকেও হয়ত কোনও কালে আর্যরা দখল করেছে। অন্তত ইচার দুর্গাকে খুব নিজের, খুব কাছের বলে মনে হল বুধমণির। নিজেকে নিজেই বোঝালো, এই দেবী দুর্গাকে সে দেখেছে রোহতাস গড়ের আদিবাসী যোদ্ধা রাজকুমারী সিনগি দেইয়ের মধ্যে, ভূমি আন্দোলনের নেত্রী দয়ামণি বারলার মধ্যে, বিশ্ব তিরন্দাজিতর উজ্জ্বল নক্ষত্র দীপিকা কুমারীর মধ্যে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিক বিরবাহা হাঁসদার মধ্যে । ইচার দেবীমূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুধমণি অনুভব করে ওই দশভূজার মুখ ক্রমশ তার মতো হয়ে যাচ্ছে। দেবীর দশটি হাত তার শরীরে স্থানান্তরিত হচ্ছে। বুধমণি বুঝতে পারে সে এত দিন নারী ছিল। এবার নারীশক্তিতে পরিণত হচ্ছে। যার লড়াই অসাম্যের বিরুদ্ধে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে।
বিজয়া দশমীর ভোরে বুধমণি টাটানগর যাওয়ার বাস ধরার জন্য কুজু নদীর ধারে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। চাইবাসা থেকে আসা বাস এসে দাঁড়াতেই বুধমণি অবাক হয়ে দেখলো ড্রাইভারের সিটে বসে হুদুড় দুর্গা। সে দেবী দুর্গাকে তার নিজের ঠিকানায় পৌঁছে দিতে এসেছে।
(মতামত লেখকের একান্তই নিজের, আজতক বাংলা এর দায়ভার নেবে না)