Advertisement

নেতাজি আসলে কার? যা জানা অত্যন্ত জরুরি

সেই সূত্রেই লেখক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, ট্যুইটারে করা আমার ‘বাম-কংগ্রেসি জালিয়াতি’র অভিযোগটি ভ্রান্ত। কিন্তু অভিযোগটি যে সম্পূর্ণরূপে ভুল নয় সেটা তিনি উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তা না করার কারণ আমার বোধগম্য নয় কারণ সদিচ্ছা থাকলে সহজেই তা করতে পারতেন।

Netaji subhash Chandra Bose and his political view
Aajtak Bangla
  • কলকাতা,
  • 01 May 2024,
  • अपडेटेड 1:12 PM IST

দু’বছর আগে সমাজমাধ্যমে আমার একটি মন্তব্যকে ভুল প্রতিপন্ন করে সম্প্রতি একটি বাংলা সংবাদপত্রের উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে যে, সুভাষচন্দ্র বসুর 'দেশদর্শন পুরোটাই হিন্দুত্ববাদী চিন্তাভাবনার বিপরীত মেরুতে'। 

১২ মে ১৯৪০ ঝাড়গ্রামের এক সভায় হিন্দু মহাসভার বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্রের কড়া সমালোচনা উদ্ধৃত করে বানানো কিছু পোস্টার সমাজমাধ্যমে বহু বছর ধরেই ঘোরাফেরা করছে। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও উদ্ধৃত উক্তিগুলির মূল সূত্র খুঁজে না পাওয়ায়, সমাজমাধ্যমে ভাসতে থাকা আরও অনেক মনীষীর উদ্ধৃতির মতোই এটিরও কোনও প্রকৃত ভিত্তি নেই বলেই আমি মন্তব্য করেছিলাম। সেই জন্য আর মন্তব্যগুলি নিয়ে আমার লেখা সুভাষচন্দ্রের জীবনীটিতে কোনও আলোচনা করিনি। আমার অনুমান ভুল প্রমাণ করে ওই সংবাদপত্রে প্রকাশিত মূল খবরটি খুঁজে বের করেছেন নিবন্ধের লেখক।

সেই সূত্রেই লেখক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, ট্যুইটারে করা আমার ‘বাম-কংগ্রেসি জালিয়াতি’র অভিযোগটি ভ্রান্ত। কিন্তু অভিযোগটি যে সম্পূর্ণরূপে ভুল নয় সেটা তিনি উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তা না করার কারণ আমার বোধগম্য নয় কারণ সদিচ্ছা থাকলে সহজেই তা করতে পারতেন। সমাজমাধ্যমে প্রচারিত হতে থাকা পোস্টারগুলিতে হিন্দু মহাসভার বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্রের সমালোচনামূলক কথাগুলির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় আরও একটি পংক্তি, 'তাঁহারা দেশদ্রোহিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছেন। এই বিশ্বাসঘাতকদিগকে আপনারা রাষ্ট্রীয় জীবন হইতে সরাইয়া দিন, তাঁহাদের কথা কেহ শুনিবেন না।' স্পষ্টতই যাঁরা সুভাষচন্দ্রের মন্তব্যগুলি পোস্টার বানিয়ে সমাজমাধ্যমে প্রচার করে চলেছেন, অর্থাৎ কংগ্রেসী ও বামপন্থীরা, তাঁরা বোঝাতে চান যে এই কথাগুলিও সুভাষচন্দ্র হিন্দু মহাসভার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন। আদতে ঘটনাটি কিন্তু তা নয়। 

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও হিন্দু মহাসভা

ওই সংবাদপত্রের মূল প্রতিবেদনটিতে ওই উদ্ধৃতির আগে লেখা ছিল, 'দক্ষিণপন্থীদের আদর্শ ও কর্ম্মপদ্ধতির তীব্র নিন্দা করিয়া শ্রীযুত বসু বলেন—জনমত উপেক্ষা করিয়া কৃত্রিম এড হক কমিটি তাঁহারা বাঙ্গলা দেশে চাপাইয়াছেন।' 

Advertisement
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু

শরৎচন্দ্র ও সুভাষচন্দ্র নিয়ন্ত্রিত বাংলার প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিকে অপসারণ করে এড হক কমিটি স্থাপন করেছিল কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি। ওই কথাগুলিও ছিল ওয়ার্কিং কমিটির প্রতি, হিন্দু মহাসভার প্রতি নয়। কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রতি সুভাষচন্দ্রের তীব্র ভর্ৎসনাকে সচেতন ভাবে লোককে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে হিন্দু মহাসভার নামে চালানোকে কোন নামে অভিহিত করা উচিত তা পাঠকের উপরই ছেড়ে দিলাম। 

এই সূত্রে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে হিন্দুত্ব চিন্তাধারার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কয়েকটি কথা স্পষ্ট করার প্রয়োজন আছে। 

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু

হিন্দু মহাসভার সমালোচনায় জোর দিতে গিয়ে যে কথা অনেকে ভুলে যান তা হল ওই হিন্দুত্ববাদী মহাসভার সঙ্গেই সুভাষচন্দ্র জোট বেঁধেছিলেন ১৯৪০-এর কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে। ঘোষণার ঠিক দু’দিন পরই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি শরৎ ও সুভাষ নিয়ন্ত্রিত বাংলার প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিকে সাসপেন্ড করে। এই সময়ে সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনার ঝড় তোলে বাংলার সংবাদপত্রগুলির একটি অংশ, বিশেষ করে অমৃতবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর (তাঁর পক্ষে থাকে আনন্দবাজার ও হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড)। সুভাষ তাঁর বিরোধী সংবাদপত্রগুলিকে বয়কটের ডাক দিলে পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল হয়; এ বিষয়ে তীব্রতর হতে থাকে তাঁর সমালোচনা, দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে ও কংগ্রেসের ভেতরেও। 

তাঁর আপস-বিরোধী সম্মেলনের বিরোধিতা করে কংগ্রসে সোশালিস্ট পার্টি। সুভাষ ও ফরওয়ার্ড ব্লকের বিরোধিতা শুরু করে কম্যুনিস্ট পার্টি পরিচালিত ন্যাশনাল ফ্রন্ট দলও। সুভাষ-অনুসারীদের সরিয়ে গান্ধী অনুগামীদের নিয়ে নতুন প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি গঠন করা হলে ১৬ মার্চ তাঁদের চা-চক্রে আপ্যায়ন করেন অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক তুষারকান্তি ঘোষ।

প্রার্থী চয়ন নিয়ে মহাসভার জোট ভেঙ্গে গেলে নির্বাচনের পর সুভাষ জোট বাঁধেন মুসলিম লিগের সঙ্গে। ঝাড়গ্রামে বক্তৃতাটি করেছিলেন এমন একটা সময়ে যখন মুসলিম লিগের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া ও কর্পোরেশন পরিচালনা নিয়ে মহাসভার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তিক্ততার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। সেই সময়ের একটি বক্তব্যকে ঠিক কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত? শ্যামাপ্রসাদের সভাও ভেঙে দিয়েছে তাঁর অনুগামীরা। কিন্তু শুধু কি শ্যামাপ্রসাদেরই? 

প্রথমে ৬ মার্চ শ্রদ্ধানন্দ পার্কে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সভায় হামলা করে সুভাষচন্দ্রের অনুগামীরা। ৭ এপ্রিল শ্রদ্ধানন্দ পার্কে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি অনুমোদিত নতুন প্রদেশ কংগ্রেসের চরকা কাটা অনুষ্ঠানে জড়ো হওয়া প্রায় একশজনের উপরও চড়াও হন সুভাষের অনুগামীরা। “সুভাষবাবু কি জয়” ও “গান্ধিবাদ নিপাত যাক” স্লোগানের মধ্যে চলে প্রবল ইট ও পাথরবৃষ্টি। ঘটে রক্তপাত। পরদিন পাথর ও বাঁশ নিয়ে আক্রমণ চলে দেশবন্ধু পার্কে নতুন প্রদেশ কংগ্রেসের আরেকটি সভায়। 

স্পষ্টতই সুভাষচন্দ্রের অনুগামীদের ঘা শুধু মহাসভাতেই সীমিত ছিল না। 

এবার আসি হিন্দুত্ব প্রসঙ্গে। 

বিনায়ক দামোদর সাভারকরের হিন্দুত্বের মূল তত্ত্ব ছিল দেশের নাম অনুসারে হিন্দুস্থান বা ভারতকে যিনি পিতৃভূমি, পবিত্রভূমি বলে মানেন, তিনিই হিন্দু। শুধু ভৌগলিক নয়, হিন্দুদের একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে গণ্য করার কারণ হল ধর্মীয়, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক একতা ও ধারাবাহিকতা। হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক জাতি, তবে দুটি জাতিকে নিয়ে এমন একটা রাষ্ট্র গঠন সম্ভব যেখানে জাতি বা ধর্মের ভিত্তিতে কোনও নাগরিকের মধ্যে প্রভেদ থাকবে না, কাউকে কোনও বিশেষ সুবিধা না দিয়ে সবাইকে সমান চোখে দেখা হবে। 

মুসলমান সমাজের প্রতি মহাসভার নেতৃবৃন্দের অবিশ্বাস অবশ্য বাড়তে থকে খিলাফত আন্দোলন, দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বাংলার রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার অভিঘাত ও মুসলিম লিগের ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে কংগ্রেস নেতৃত্বের সদিচ্ছার প্রতি সন্দিহান হয়েই মহাসভার রাজনীতিতে পদার্পণ। সুভাষও দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল-এ লিখেছেন মহাসভার উৎপত্তি মুসলিম লিগের রাজনীতির প্রতিক্রিয়া রূপে। তবে সুভাষ মুসলিম লিগকে ভারতের মুসলমান সমাজের প্রতিনিধি নয়, এক অত্যন্ত ক্ষুদ্র অংশ বলেই মনে করতেন। ১৯৪৫-৪৬ সালে তিনি দেশে ফিরলে সেই ক্ষুদ্র অংশ কী বিশাল বিস্তার লাভ করেছিল তা দেখে নিশ্চয়ই বিস্মিত ও হতাশ হতেন। তিনি দেশে ফিরলে অবশ্য জল অতদূর গড়াতো কি না সেটা অন্য প্রশ্ন। 

Advertisement

বলাই বাহুল্য, এই দ্বিজাতি তত্ত্ব সুভাষের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাঁর মতে ভারতে মুসলমানদের আগমনের পরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এক নতুন সমন্বয়। হিন্দু ধর্ম গ্রহণ না করলেও তাঁরা এক সাধারণ সামাজিক জীবন ভাগ করে নেন। শিল্প, স্থাপত্য ও সঙ্গীতে দুই সভ্যতার মিলনে এক নতুন ধারার সৃষ্টি হয়। 

তবে অন্যান্য মতাদর্শের মতোই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুত্বের ধারণারও বিবর্তন হয়েছে। দেশ বিভাজনের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পরিস্থিতির সঙ্গেই তা বদলেছে। লাজপত রাই, মদনমোহন মালব্য, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, সাভারকর, গোলওয়ালকর, সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ ও বর্তমানে মোহন ভাগবত যে হুবহু একই মতের পথিক তা কেউই দাবি করবেন না। শ্যামাপ্রসাদ মহাসভা ছেড়ে বিনা কারণে জনসঙ্ঘ তৈরি করেননি। ভারতের হিন্দু ঐতিহ্য তার মূল ভিত্তি থেকে গেলেও একবিংশ শতাব্দীতে নরেন্দ্র মোদীর “সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস, সবকা প্রয়াস”-কে বিংশ শতাব্দীর ত্রিশ বা চল্লিশের দশকের হিন্দুত্ববাদকে একাসনে বসানো মূঢ়তা ভিন্ন কিছু নয়। 

৩০ মার্চ ১৯৪০ ফরওয়ার্ড ব্লক মুখপত্রে স্বাক্ষরিত সম্পাদকীয়তে সুভাষচন্দ্র লেখেন, যে বাঙালি হিন্দুরা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মেরুদণ্ডস্বরূপ, তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসাটা হিন্দু মহাসভার ইতিহাসে একটা নতুন অধ্যায়। সেখানেই ছিল তাঁর আপত্তি, 'প্রকৃত হিন্দু মহাসভার সঙ্গে আমাদের কোনও ঝগড়া বা সংঘাত নেই। কিন্তু রাজনৈতিক হিন্দু মহাসভা জনজীবনে কংগ্রেসকে প্রতিস্থাপন করার উদ্দেশ্যে আমাদের বিরুদ্ধে পা বাড়ানোয় তার সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য।' ঝাড়গ্রাম বক্তৃতাতেও তিনি বলেন, 'হিন্দু মহাসভা হিন্দু মহাসভার কাজ করুক, কংগ্রেস কংগ্রেসের কাজ করুক তাহা হইলে গোলমাল থাকে না।' ফরওয়ার্ড ব্লকের সেই সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয় সাভারকরের উপর একটি পূর্ণতর প্রতিবেদন, যেখানে তাঁর বিপ্লবী সত্ত্বার প্রশংসা করা হলেও তাঁর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কঠোর সমালোচনা করা হয়। বলা হয় যে 'দৃশ্যতই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার ভয়ানক বৃদ্ধির ফলে শ্রী সাভারকরের মনে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে। নিঃসন্দেহে এই বৃদ্ধি দেশের বর্তমান রাজনীতির পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক,' কিন্তু সেই জন্য দেশকে দুটি যুযুধান শিবিরে ভাগ করে ভবিষ্যতে রক্তপাতের জন্য প্রস্তুত করা ঠিক নয়। 

হিন্দু মহাসভার প্রতি সুভাষের আপত্তি তীব্রতর হয় মহাসভার রাজনৈতিক দাবিগুলিকে ঘিরে—যেমন যুদ্ধান্তে ভারতের জন্য ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস ও ১৯৩৫-এর সংবিধানের ফেডারেশন অংশটি অবিলম্বে কার্যকর করা—যার বিরুদ্ধে সুভাষের অবস্থান ছিল অনমনীয়। স্পষ্টতই সুভাষচন্দ্রের প্রধান আপত্তি ছিল হিন্দু মহাসভার রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে। 

হিন্দু মহাসভার দ্বিজাতিত্ত্ব ও রাজনৈতিক কার্যাবলী সরিয়ে রাখলে অবশ্য হিন্দুত্বের মূল ধারণার সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের ভারতেতিহাস ধারণার খুব অমিল ছিল না। সেই ধারণার ভিত্তি ছিল তাঁর নিজের হিন্দু চেতনা, বা হিন্দুত্ব। দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল-এ তিনি লেখেন, ইতিহাসের ধারা বেয়ে ভারত যে বহু জাতিকে আপন করে নিয়ে একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে তুলতে পেরেছে তার সবচেয়ে বড় কারণ হিন্দুধর্ম। “সমস্ত হিন্দু ভারতকে পবিত্র ভূমি হিসাবে দেখে।” তিনি লেখেন “উত্তর হোক বা দক্ষিণ, পূর্ব হোক বা পশ্চিম, যেখানেই যান সেখানেই পাবেন একই ধর্মীয় ভাবনা, একই সংস্কৃতি এবং একই ঐতিহ্য।” একই ধরনের কথা তিনি বলেন ১৯৪৪-এর নভেম্বরে টোকিও ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটিতে তাঁর বক্তৃতাতেও। 

Advertisement

১৯২৭-এ সুভাষ তাঁর মেজবৌদিদি বিভাবতী দেবীকে লেখেন, “ছেলেদের সকলকে কাশীরাম দাসের মহাভারত ও কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়তে দিবেন।...মহাভারত ও রামায়ণ আমাদের সভ্যতার মূলভিত্তি, একথা আমি যত বড় হচ্ছি তত বুঝতে আরম্ভ করেছি”।

রাজনীতিতে ব্যবহৃত সুভাষচন্দ্রের ভাষাও ছিল হিন্দু কৃষ্টির উপমায় সম্পৃক্ত। এই ব্যবহার বারবার দেখা যায় তাঁর বক্তৃতা ও নানা রচনায়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২৫ সালের শেষের দিকে ‘দেশের ডাক’ প্রবন্ধে লেখেন:
“বঙ্গজননী আবার একদল নবীন তরুণ সন্ন্যাসী চান।...মায়ের হাতে তোমরা পাবে শুধু দুঃখ, কষ্ট, অনাহার, দারিদ্র্য ও কারাযন্ত্রণা। যদি এই সব ক্লেশ ও দৈন্য নীরবে নীলকন্ঠের মত গ্রহণ করতে পার—তবে তোমরা এগিয়ে এসো...তোমরাই তো সকল দেশে আত্মদানের পুণ্য ভিত্তির উপর জাতীয় মন্দির নির্মাণ করেছ...তাই বলছি, তোমরা সকলে এসো, ভ্রাতৃবন্ধনের “রাখি” পরিধান করে, মায়ের মন্দিরে দীক্ষা নিয়ে আজ এই প্রতিজ্ঞা করো যে, মায়ের কালিমা তোমরা ঘুচাবে, ভারতকে আবার স্বাধীনতার সিংহাসনে বসাবে এবং হৃতসর্বস্বা ভারতলক্ষ্মীর লুপ্ত গৌরব ও সৌন্দর্য পুনরুদ্ধার করবে।” 

সুভাষচন্দ্রের ধর্ম চেতনাকে যদি আজকের রাজনৈতিক মতাদর্শের সংঘাত বিতর্কে হিন্দুত্বের বিপরীতে তুলে ধরা হয়, তা সমান ভাবে করা প্রয়োজন ভারতীয় রাজনীতিতে সেক্যুলারিজমের ধারণার বিকৃতির ক্ষেত্রেও। 

ব্যক্তিগত জীবনে সুভাষচন্দ্র যে অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ ছিলেন তা অনেকেরই জানা, কিন্তু ধর্মকে কি তিনি কখনও রাজনীতির ক্ষেত্রে ব্যবহার করেননি? জেলের ভিতর আনুষ্ঠানিক ভাবে পুজো করার অধিকার নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যেভাবে বারবার সংঘর্ষে গিয়েছিলেন, তা কিন্তু অন্য কথা বলে। মান্দালয় জেল থেকে কর্তৃপক্ষকে তিনি লেখেন “আমাদের কাছে ধর্ম নিছক সামাজিক সম্মিলন, বুদ্ধিবিলাস বা ছুটির দিনের উৎসব নয়।...ধর্ম আমাদের সমগ্র জাতীয় ও ব্যক্তিসত্তায় পরিব্যাপ্ত। এর ভিত্তিতেই আমাদের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে উঠেছে।” তিনি প্রশ্ন তোলেন কেন “সামান্য কয়েকজন খ্রীস্টান অপরাধীর ধর্মানুষ্ঠান পালনের জন্য বছরে ১২০০ টাকা দেওয়া হয়, কিন্তু উচ্চশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান হিন্দু রাজবন্দীদের ধর্মানুষ্ঠান পালনের জন্য একটা পয়সাও দেওয়া হয় না।” ১৯২৮-এ তিনি সিটি কলেজে সরস্বতী পুজো করার দাবিতে আন্দোলনরত হিন্দু ছাত্রদের প্রকাশ্যে সমর্থন করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। 

হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে সুভাষ যেমন খড়গহস্ত ছিলেন, তেমনই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে স্পষ্ট কথা বলতে সংকোচ করতেন না। ১৯৩৭-এ বন্দে মাতরম বিতর্ক নিয়ে তিনি জওহরলাল নেহরুকে লেখেন, “আজ যদি তুমি ‘বন্দে মাতরম’-এর ব্যাপারে [সাম্প্রদায়িক মুসলমানদের] পুরোপুরি সন্তুষ্ট করো, কাল তারা আবার নতুন দাবি তুলতে দেরি করবে না।” বর্তমান সেক্যুলার রাজনীতিকদের মতো তাঁকে তাঁর হিন্দু পরিচয় ও চেতনা লুকিয়ে চলতে হয়নি। তাঁর কথায় ও কাজে তার প্রকাশ স্বাভাবিক। পাছে তা অন্য কারও অনুভূতিতে আঘাত করে সেই ভয় তাঁর মধ্যে দেখা যায়না। 

আজকে অনেকেই নরেন্দ্র মোদীর নেতাজি বন্দনাকে অকস্মাৎ ও রাজনৈতিক চাল মনে করে সমালোচনা করেন। কিন্তু যদি মনে রাখা হয় যে তীব্র মতবিরোধ সত্ত্বেও সাভারকর ও শ্যামাপ্রসাদ যতদিন বেঁচে ছিলেন সুভাষচন্দ্রের ভূয়সী প্রশংসা করে গেছেন তাহলে আর আশ্চর্য হওয়ার কারণ থাকে না। একই সঙ্গে তাঁকে অখণ্ড ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বলার জন্য কঙ্গনা রানাউত বা বিজেপি-কে কটাক্ষ করা অর্থহীন। সে দাবি তুলেছিলেন নেতাজির পরিবারের সদস্যরা এবং তৃণমূল কংগ্রেসও। তবে অনেকেই হয়ত আশ্চর্য হবেন যে আজাদ হিন্দ সরকারকে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্র হিসাবে প্রমাণ করতে সর্বপ্রথম সওয়াল করেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে ভুলাভাই দেশাই, ১৯৪৫-এ লাল কেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকদের কোর্ট মার্শালের সময়। সেই স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীকে তাহলে কী বলা উচিত?   

যাঁরা দাবি করেন গান্ধীর সঙ্গে সুভাষের সংঘাত নাকি শুধু “আন্দোলনের পথ নিয়ে, দেশের স্বরূপ নিয়ে নয়,” তাঁদের মনে করিয়ে দেব ৩১ অক্টোবর ১৯৪০ প্রেসিডেন্সি জেল থেকে তিনি মেজদাদা শরৎকে কংগ্রেসে গান্ধিবাদী নেতাদের সম্পর্কে লেখেন, “স্বাধীনতার পর যদি ক্ষমতা এমন নিকৃষ্ট, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও অনৈতিক লোকেদের হাতে যায় তাহলে দেশের অবস্থা কী হবে!...জাতীয় পুনর্গঠন নিয়ে এঁদের কোনও ধারণাই নেই। স্বাধীন ভারতকে যদি অহিংস গান্ধিবাদী নীতির ভিত্তিতে গড়ে তোলা হয় তাহলে দেশ অধঃপাতে যাবে।” 

Advertisement

কমিউনিজম নিয়েও সুভাষচন্দ্রের মতামত স্পষ্ট। শ্রেণি সংগ্রামের মতো মৌলিক কমিউনিস্ট তত্ত্বকেও তিনি গুরুত্ব দিতে রাজি হননি, রাজি হননি মার্ক্সবাদে অর্থনীতির উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ গ্রহণ করতেও। ভারতের জন্য যথোপযুক্ত সমাজতন্ত্রকে তিনি খুঁজেছেন দেশের প্রাচীন ইতিহাসে। হিরেন মুখার্জি বা পি সি জোশীর মতো কমিউনিস্ট নেতারা সুভাষের সমাজতান্ত্রিক দর্শনকে গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। অক্ষশক্তির সঙ্গে সুভাষ হাত মেলানোর পর কমিউনিস্টদের কুকথার যে বন্যা বয়েছিল সময়ের দাবিতে তা থামাতে হলেও, ঘটনাটা আজও তাঁদের গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে। 

ছোট করে বলতে হলে, সুভাষচন্দ্রের জীবনদর্শন বা দেশদর্শনকে কোনও দলই আপন করে নিতে পারেনি, তা সম্ভবও নয়। সুতরাং তাঁর মতের একটা দিক অসম্পূর্ণভাবে তুলে অন্য মতকে ভুল প্রমাণ করতে যাওয়াটা তঞ্চকতা ছাড়া কিছু নয়। সেই জন্যই তাঁর জীবনীর নামে রেখেছি, বোস: 'দ্য আনটোল্ড স্টোরি অফ অ্যান ইনকনভিনিয়েন্ট ন্যাশনালিস্ট'।

Disclaimer: এই প্রতিবেদন লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব মতামত। bangla.ajtak.in দায় নিচ্ছে না। 

Read more!
Advertisement

RECOMMENDED

Advertisement