
এই চিত্রনাট্যের নাম দেওয়া যেতেই পারে 'ভয়'। কে কত ভয় দেখাতে পারে! তার যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। মানুষ দিশেহারা। একদল বলছে, ' কোনও ভয় নেই, আমরা আছি।' আরেক দলও বলছে, 'আপনি যদি নাগরিক হোন, তাহলে কোনও ভয় নেই। আমরা আছি।' দিনের শেষে কমন ফ্যাক্টর, 'ভয়'। SIR নিয়ে যখন বঙ্গের একটি বড় অংশের মানুষ নানা প্রশ্ন, সংশয়ে জেরবার হচ্ছেন, তখন বিজেপি-র অস্ত্রেই বিজেপিকে ঘায়েল করার স্ট্র্যাটেজি নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই স্ট্র্যাটেজির নাম 'ভয়'।
BJP-র হাতিয়ার যখন SIR
SIR ইস্যুতে বঙ্গ বিজেপি প্রথম থেকেই বেশ আক্রমণাত্মক ভূমিকায়। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বারবার হুংকার দিচ্ছেন, 'দেড় কোটি, দু কোটি লোকের নাম বাদ পড়বে।' বিজেপি-র দাবি অনুযায়ী, প্রচুর বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর নাম ভোটার তালিকা থেকে মুছে যাবে। ফলে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কে ফাটল ধরবে। বিজেপি-র ক্ষমতায় আসার পথ চওড়া হবে। বস্তুত, মুসলিমরা যে বিজেপি-কে ভোট দেন না, তা প্রকাশ্যেই স্বীকার করে গেরুয়া শিবির। আবার পশ্চিমবঙ্গে প্রতি নির্বাচনেই মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকেই যায়। বাম, কংগ্রেস থেকে বহু বছর ধরেই মুখ ফিরিয়েছেন সংখ্যালঘুরা। SIR ইস্যুতে বিজেপি 'বাংলাদেশি মুসলমান'তত্ত্ব খাড়া করে যে আবহ তৈরি করতে চাইছে, সেই আবহে কোনও ভাবে মুসলমান সম্প্রদায়ের মনে একটি ভীতি তৈরির চেষ্টাও দৃশ্যত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন দাবি করলেন, '২ কোটি ভোটারের নাম বাদ দিয়ে বিজেপি বাংলায় ক্ষমতায় আসতে চাইছে।'
বিজেপি-র অস্ত্রেই বিজেপি-কে ঘায়েলের স্ট্র্যাটেজি মমতার
পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকা সংশোধন এই প্রথম নয়। অতীতেও একাধিকবার হয়েছে। নির্বাচন কমিশনই জানাল সাংবাদিক সম্মেলনে, অতীতে ৮ বার হয়েছে এই সংশোধন। সুতরাং স্পেশাল ইন্টেনসিভ রিভিশন বিষয়টি নতুন নয়। তাহলে 'ভয়ের রাজনীতি' ঠিক কীভাবে চলছে বাংলায়? এখানেই চোখে পড়ার বিষয়, মমতা কী ভাবে বিজেপি-কে বিজেপি-র অস্ত্রেই ঘায়েলের পন্থা নিয়েছেন? স্ট্র্যাটেজিক ভাষায় বললে, Counter Narrative by Fear।
তৃণমূল কংগ্রেস বার বার হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, একটাও বৈধ ভোটারের নাম বাদ গেলে আন্দোলন হবে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বারবার অভয়বাণী, 'কোনও ভয় নেই। আমরা আছি।' এই যে বারবার ভয় শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে, এর পিছনেই রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্ক। এখানে ফিরে দেখা যাক ২০২১ সালের ভোটের দিকে। সে বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অস্ত্র ছিল 'বহিরাগত'। অর্থাত্ বাঙালি আবেগকে কাজে লাগানোর কৌশল। একাধিক সভায় মমতা বলতেন, 'BJP-কে ক্ষমতায় আনলে মাছ, মাংসের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হবে বাংলা।' কাজে লেগেছিল সেই ফর্মুলা। বিধানসভা ভোটে সাফল্য এসেছিল। বিজেপি সে বার বিরোধী দলের জায়গা পেলেও, ক্ষমতায় আসার যে ধুয়ো উঠেছিল, তা ম্লান হয়ে যায় বিধানসভা নির্বাচনের রেজাল্টেই।
কাট টু ২০২৬। SIR ইস্যুতে বারবার নথি, BLO ইত্যাদি নিয়ে সতর্ক করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, 'সবাই ভাবছে আমার নামটা বাদ যাবে না তো ? বাংলা ভাষায় কথা বললেই বাংলাদেশি হয় না, হিন্দি ভাষায় কথা বললেই পাকিস্তানি হয়ে যায় না।'
ভয়ের পাল্টা ভয়
SIR ইস্যুকে খাড়া করে বিজেপি যেভাবে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের তাড়ানোর নামে ভয় দেখাচ্ছে, তৃণমূল কংগ্রেসকেও দেখা যাচ্ছে, পাল্টা ভয় দেখিয়ে বিজেপি-র স্ট্র্যাটেজিকে মোকাবিলা করার চেষ্টা। এখন এই ভয়ের রাজনীতিতে শেষ পর্যন্ত কারা জয়ী হয়, তা সময়ই বলবে। তবে SIR ইস্যুতে যে রাজনীতিটি বিজেপি করছে, মমতার পাল্টা রাজনীতিতে বিধানসভায় বাংলার একটি বড় অংশের মানুষ যদি বিজেপি-কে 'ভয়ে' ভোট না দেয়, তা হলে কিন্তু বিজেপি নিজেদের অস্ত্রেই নিজেরা ঘায়েল হয়ে যেতে পারে।
মানুষ ভয় পেতে পেতে একসময় বিরক্ত হয়ে যেতেই পারে। SIR ইস্যুকে ব্যবহার করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত মানুষের বিরক্তির শিকার হবে না তো বঙ্গ বিজেপি? প্রশ্নটা রয়েই যাচ্ছে। মোদ্দা বিষয়, ২০২৬ সালের নির্বাচনেও বিজেপির মূল লড়াই সেই 'বাঙালির পার্টি' হওয়ার। বিজেপি যদি নিজেদের তৈরি ‘ভয়’এর ফাঁদে নিজেরাই আটকে যায়, তাহলে ২০২৬-এর ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাসি আরও চওড়া হতে পারে।