Advertisement

জাতিভিত্তিক সংরক্ষণ: শুধু ভাবছি, আমি কী অপরাধ করলাম?

আমি তো জন্মসূত্রে হিন্দু ব্রাহ্মণ। আমার জীবনে ব্রাহ্মণ হওয়ার ঘটনাটি নিছকই ইন্সিডেন্টাল। এমন নয় আমি ব্রাহ্মণ হতে চেয়েছিলাম,এটাই আমার এইম ইন লাইফ ছিল। এমনও তো নয় পূর্ব জন্মের প্রারব্ধ কর্মের জন্য এ জন্মে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর বর্ণভেদ প্রথার ব্যাকরণ মেনে আমাকে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

জয়ন্ত ঘোষাল
জয়ন্ত ঘোষাল
  • নয়াদিল্লি,
  • 09 Oct 2023,
  • अपडेटेड 9:40 AM IST

গোটা দেশজুড়ে  সংরক্ষণ নিয়ে আর একবার আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। মেয়েদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে গিয়ে অনেকে আবার ওবিসি,দলিত,যাদব,নিম্ন বর্ণের জন্য আরও কোটা চালু করার দাবিতে সোচ্চার। 

হায়!

গালে হাত দিয়ে শুধু ভাবছি, আমি কী অপরাধ করলাম?

আমি তো জন্মসূত্রে হিন্দু ব্রাহ্মণ। আমার জীবনে ব্রাহ্মণ হওয়ার ঘটনাটি নিছকই ইন্সিডেন্টাল। এমন নয় আমি ব্রাহ্মণ হতে চেয়েছিলাম,এটাই আমার এইম ইন লাইফ ছিল। এমনও তো নয় পূর্ব জন্মের প্রারব্ধ কর্মের জন্য এ জন্মে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর বর্ণভেদ প্রথার ব্যাকরণ মেনে আমাকে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। 

হাওড়ার এক এঁদো গলিতে জন্মালাম। সোনার চামচ-রুপোর চামচ মুখে দিয়ে তো নয়। জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার সময় ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার সুযোগ পেল আমার বন্ধু সনৎ মণ্ডল। সিডিউল কাস্ট কোটায়। সনৎ লেখাপড়ায় চিরকাল ছিল পিছড়ে বর্গ। আমাদের টেনিদার মতো ফেলুরাম। মেধার উৎকর্ষে নয়,কোটায় ইঞ্জিনিয়ার হল সনৎ।

 
সনতের বাবা বড় ব্যবসায়ী। ধনী পরিবার। ঠাকুরদার তৈরি করা লোহার পাইপ তৈরির কারখানা। প্রশ্ন করেছিলাম, হ্যাঁ রে সনৎ, তুই তো বড়লোক বাপের ছেলে। তুই তো 'হ্যাভ নট' নোস। তুই কেন কোটায় ইঞ্জিনিয়ার হবি? তোর তো প্রতিবাদ করে প্রত্যাখ্যান করা উচিত এই সুযোগ। রে রে করে উঠেছিল সনৎ। তুই কি জানিস, তোরা ব্রাহ্মণরা মানে মনুবাদী উচ্চবর্ণ যুগের পর যুগ এদেশের আদিবাসী অন্তজ সমাজের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। আজ তার অ্যান্টি থিসিস হল এই কোটা ব্যবস্থা। অতএব এখন এই উল্টো রথের প্রক্রিয়া চলবে যুগের পর যুগ। এ হল ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের জিহাদ। 

তা হলে পথের পাঁচালীর অপুর বাবা গরিব যজমান হরিহর কী করবে?

Advertisement

আর্থিক অনটনে তো তাঁকে নিশ্চিন্দিপুর থেকে পালিয়ে চলে যেতে হয়েছিল বেনারস, জীবিকার তাড়নায়। সেখানে হরিহরের মৃত্যু হলে কলকাতা ফিরে এসে শুরু হয় অপুর জীবন সংগ্রাম। বেচারা বামুনের পো!


যোগেন্দ্র যাদব অবশ্য বলেছেন, জাতিভিত্তিক জনগণনা বিশেষ প্রয়োজন। আপনি সংরক্ষণের পক্ষে না বিপক্ষে সেটা ইস্যু নয়। ইস্যু হল কোন জাতের কত মানুষ তা জানা প্রয়োজন।  যোগেন্দ্র বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের বিখ্যাত সাইনি জাজমেন্ট বলছে প্রত্যেক ১০ বছর অন্তর দেখতে হবে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের সুবিধা কে পাচ্ছে কে পাচ্ছে না। অতএব জাতিগত আদমসুমারি না হলে এ প্রমাণ পাওয়া যাবে কী করে?

১৯৩১ সালের পর থেকে প্রত্যেক আদমসুমারিতে ওবিসি ও দলিত জনগণনা সঠিকভাবে হয়েছে কী হয়নি সেটা নিয়েও মতপার্থক্য আছে। অনেকে বলছেন, প্রত্যেক আদমসুমারিতে জেলাওয়াড়ি পরিসংখ্যান সুষ্ঠুভাবেই নেওয়া হয়। এখন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, সঠিক জনগণনা হলে ওবিসি হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমাজ হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে হিন্দু ওবিসি হবে এই জাতি ব্যবস্থার ডমিনেন্ট পার্টনার। আর আমি শ্রী শ্রীমান শ্রীল ঘোষাল মহাশয় বাৎস্য গোত্র -কি তবে জনগণনার রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর হয়ে যাব সংখ্যালঘু? তখন কি ভারতে  শিক্ষাক্ষেত্রে,কর্মক্ষেত্রে ব্রাহ্মণরা কোটা পাবে? সে হবে এক নতুন ভারত। 

সংসদের প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুভাষ কাশ্যপ এ ব্যাপারে বলেছেন ,আম্বেদকার যদি এখন বেঁচে থাকতেন, তবে তিনি আঁতকে উঠতেন। খুব দুঃখ পেতেন। স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও এখনও দলিতদের সংরক্ষণ দিতে হচ্ছে। এখনও সংরক্ষণের জন্য কোটার জন্য দাবি ক্রমাগত বাড়ছে। আসলে ভীমরাও আম্বেদকারও বলেছিলেন, স্বাধীনতার পর দশ বছর যদি সংরক্ষণ দেওয়া হয়, রাজনীতিতে যদি নিম্নবর্গের ক্ষমতায়ন হয় তবে দেশের জাতপাতের বৈষম ,শ্রেণি বৈষম্য ঘোঁচানো সম্ভব হবে। দশ বছর পর তিনি সংরক্ষণের বিষয়টি পর্যালোচনা করতে চান।
 
জেএনইউ-এর অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অপরাজিত চট্টোপাধ্যায় বলেন, আসলে অষ্টাদশ শতাব্দীতেই আমরা ব্রাহ্মণরা বোধ হয় এ দেশে সংখ্যালঘু হয়ে গেছি বাস্তবে। কারণ ব্রাহ্মণদের তো জমি ছিল না। ভূস্বামী ব্রাহ্মণ ছিল না। লর্ড ক্লাইভ আর হেস্টিংস ভারতীয়দের জমির মূল্য বোঝালো। জমি কেনা বেচা বিনিময় হল। জগত্‍ শেঠের ব্যাঙ্ক হল, কিন্তু ব্রাহ্মণরা কী হয়েছিল? কী পেয়েছে তারা? সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডারের কর্ণধার দেবাশিস ভট্টাচার্য বলেন ,অতীতে ব্রাহ্মণদের মধ্যেও তো চার রকমের স্তর ছিল। কেউ রান্নার ঠাকুর ছিল, কেউ ছিল যজমান, কেউ শিক্ষক আর সর্বশ্রেষ্ঠ স্তরটিতে ছিল ধর্মপ্রচারক।

 
ঝাড়খণ্ডের পিছড়ে বর্গের কমিশনের নেতা রাজারাম  মাহাতো বলেন, এ রাজ্যে যারা গোস্বামী, তারা ওবিসি মর্যাদা পাবেন। গো-স্বামী শব্দের অর্থ হল গো মানে পৃথিবী আর স্বামী মানে পতি বা প্রভু। এটি হিন্দু পুরোহিত শ্রেণি ছিল। অর্ণব গোস্বামী (অসম) থেকে পাঞ্জাবি অভিনেত্রী বিন্দিয়া গোস্বামী (পাঞ্জাবি) এঁরা সবাই বৈষ্ণব ধর্ম জাত। বঙ্গদেশের শ্রীচৈতন্য ভক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে নিম্ন জাতিকেও উর্ধ্বমুখী সচলতা দিয়েছেন। 


শ্রীচৈতন্য প্রজ্ঞাতি ভোজন চালু করে উচ্চ বর্ণের বিরুদ্ধে নিম্নবর্গের  অসন্তোষ বিদ্রোহকে প্রশমিত করে দেন। আর আজ এত বছর পর সেই স্বাতন্ত্র নতুন করে তেড়ে-ফুঁড়ে উঠলে ব্রাহ্মণ-কায়েত-ভূমিহার-যাদব-জাঠদেরও লড়াই তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। জাঠরা ওবিসি কি ওবিসি নয় তা নিয়ে বিতর্ক হবে। তাহলে হে ধর্মাবতার , ঘোষালদেরও ওবিসি সম্মান দিন। দলিত যদি আইএএস হয় তবে তার সন্তান আর কোটার সুবিধে পাবে না এ আইন হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে কি এই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রতিষ্ঠিত ওবিসি পরিবারকে কোটা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে? হয়নি। উল্টে মুসলিমদের ক্ষেত্রে ওবিসি কোটার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ইসলাম ধর্মে জাত পাত নেই কিন্তু জাভেদ আনসারী দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওবিসি কোটায় শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছে। আনসারীর বাবা দিল্লিতে ধনী কার্পেট ব্যবসায়ী। জাভেদ কোটার সত্ব ভোগী। 

Advertisement

আমেরিকাতেও নিম্নবর্গের ক্ষমতায়নের জন্য অধিকার আছে কিন্তু সে ক্ষেত্রে মেধার উৎকর্ষের সঙ্গে কোনোভাবেই আপোষ করা হয় না। ম্যারিটোক্যাসির বিচার হয় পৃথক পরীক্ষায়। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক আইনের শিক্ষিকা ও গবেষিকা, আমিয়া কিলারা একথা জানিয়ে বলেন , পিছিয়ে পড়া মানুষের আর্থিক অসাম্য ঘোছানোর চেষ্টা মার্কিন অ্যাফারমেটিভ আইনে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ডক্টর আম্বেদকর চেয়ার ফর সোশ্যাল চেঞ্জ এন্ড ডেভেলপমেন্ট-অধ্যাপক গেইল ওমবেট ( Gail ombet ) বলেন আম্বেদকারের মতে হিন্দুত্ব হল 'প্রতি বিপ্লব'। তাই বিজেপি জাতপাত গণনায় আগ্রহী নয়। হিন্দুত্বর আখ্যান তাদের অগ্রাধিকার। 


কিন্তু আপনারাই বলুন , আমি কি দোষ করেছি? জাতপাতের গণনাই হোক আর হিন্দু রাষ্ট্র ব্রাহ্মণদের কোটা কবে হবে? একে হিন্দু তাও আবার বাঙালি। 

আমি কী অপরাধ করেছি?  আপনারাই বলুন।
 

Read more!
Advertisement

RECOMMENDED

Advertisement