পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন (Panchayat Election 2023) ৮ জুলাই। আর মাত্র তিন দিন বাকি। ইংরেজিতে যাকে বলে কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু হিংসা থামল কই? হিংসার জন্য কোন দল বেশি ভিকটিম হল তার বিচার পরে হবে। কিন্তু একথা বলা যায়, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে যেমন রাজনৈতিক হিংসা হয়েছিল বা তার আগেও পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে রকম রাজনৈতিক হিংসা হয়েছিল এইবারের নির্বাচনেও কিন্তু তার অন্যথা হল না।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় চেষ্টা করেছিলেন। তিনি প্রত্যেকটি জেলায় গিয়ে প্রাক পঞ্চায়েত নির্বাচনী প্রচারে বলেছিলেন, হিংসা হতে দেব না। কিন্তু তাঁর চেষ্টার ত্রুটি না থাকলেও দেখা গেল প্রতিদিন বোমাবাজি , গোষ্ঠী সংঘর্ষ নানান ধরনের মারামারি লেগেই রয়েছে। সাম্প্রতিকতম দুঃখের ঘটনা ঘটেছে দেগঙ্গায়। সেখানে শ্বেতপুরে তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীদের একটা মিছিল যাচ্ছিল সেই মিছিলকে লক্ষ্য করে ছাদ থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। যে তৃণমূল কর্মীরা মিছিলে যাচ্ছিল তারা কম বেশি আক্রান্ত হলেও কেউ মারা যায়নি। কিন্তু রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটি সতেরো বছরের ছাত্র যার নাম ইমরান হাসান সে কিন্তু বোমার আঘাতে নিহত হয়েছে। এই যে নিরপরাধ ইমরান হাসানের মৃত্যু হল তাহলে এর দায়িত্ব কে নেবে?
তৃণমূল কংগ্রেস বলছে, যেহেতু তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীদের মিছিলে আক্রমণ হয়েছে এটা করেছে বিরোধী পক্ষ। অনেকে সিপিআইএম এবং আইএস'র বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে। কেউ কেউ বলছে বিজেপিও এদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রয়েছে।কে দায়ী সেটা তদন্ত সাপেক্ষ। কিন্তু এটা বলা যায় যে হিংসা পশ্চিমবঙ্গের স্তব্ধ হল না।। আবার একই রকম ভাবে বাঁকুড়ার মেজিয়া ব্লকের হিঙ্গলগঞ্জে সেখানে কিন্তু নির্দল প্রার্থীর সঙ্গে তৃণমূল প্রার্থীর বিপুল সংঘর্ষ হয়েছে দুটো গোষ্ঠীর মধ্যে। এই নির্দল প্রার্থী কারা? এরা কি বিজেপি প্রার্থী? এরা কি সিপিএম প্রার্থী? বহু ক্ষেত্রে কিন্তু এমনও দেখা যাচ্ছে যে তৃণমূল কংগ্রেসের যারা টিকিট পায়নি তারা অনেকে নির্দল প্রার্থী হয়ে গেছে। তার ফলে মূলত লড়াইটা কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে তৃণমূলেরই হচ্ছে। ওই যে বিক্ষুব্ধ নির্দল প্রার্থী তাকে হয়তো রাজনৈতিকভাবে সহায়তা দিচ্ছে বিজেপি বা বিরোধী দল। তার কারণ তৃণমূলকে ধরাশায়ী করতে গেলে নির্দল প্রার্থীকে দিয়ে ধরাশায়ী করাটা সহজ হবে। এটা একটা রাজনৈতিক রণকৌশল।
এই রণকৌশল ও কিন্তু নতুন নয়, অতীতেও হয়েছে। ঠিক এইভাবে ঘটনার পর ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে হয়ে চলেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের যে রকম গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আবার তৃণমূলের পক্ষ থেকে হামলার ঘটনাও কিন্তু হয়েছে। বেশ কিছু জায়গায় তৃণমূল কর্মীরাও কিন্তু আক্রমণাত্মক হয়ে বিজেপির উপরেও হামলা চালিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করতে গেলে একটা কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ তখনই হয় যখন সেটা কিছুটা সমানে-সমানে হয়। অর্থাৎ পঞ্চায়েতে যখন সিপিএম ক্ষমতায় ছিল তখন সিপিএমের সঙ্গে অন্য কোনো বিরোধী দলের লড়াই হত না। যখন কংগ্রেস কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছিল তখন কংগ্রেস তৃণমূলের সংঘর্ষই হতো না। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস যখন ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠল তখন বেশ কিছু জায়গায় যেরকম গ্রামাঞ্চলে দেখা গেল তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সংঘাত বেধেছিল সিপিএমের। তার কারণ সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংগঠনিক শক্তি তৈরি হয়েছিল। প্রয়াত ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা অশোক ঘোষ একদা বুঝিয়েছিলেন যে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকার সময়ও শরিকি সংঘর্ষ হত । সিপিএমের সঙ্গে সিপিআই -র সংঘর্ষ হত মেদিনীপুরে। ফরোয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে হত উলুবেড়িয়া কিংবা কুচবিহারে।এস ইউ সি আই-র সঙ্গে হত কুলতলির জয়নগরে। যদিও এসইউসিআই তখন বামফ্রন্টের শরিক ছিল না। অশোকবাবু বুঝিয়েছিলেন, তার কারণ ফরওয়ার্ড ব্লকের শক্তি উলুবেড়িয়া এবং কুচবিহারে ছিল বলে সিপিএমের সঙ্গে তাদের মারামারি হত। ঠিক যেমনটা মেদিনীপুরে এবং জয়নগরে এসইউসিআই-এর সংগঠন ছিল। তাহলে সেই একই যুক্তিতে আজ তৃণমূলের সঙ্গে যেখানে প্রতিপক্ষের লড়াই বাধছে সেখানে কিন্তু বিরোধী পক্ষ হিসেব অনেক জায়গায় বিজেপি অথবা সিপিআইএম শক্তিশালী হয়ে উঠেছে অনেকটা।
সেই কারণে বিজেপিও কিন্তু আক্রমণাত্মক হচ্ছে। উত্তর দিনাজপুরের বসাকপাড়ায় কানহাইয়া লাল বনাম করিম চৌধুরীর লড়াই, সেখানে দেখা গেছে এবং সেখানে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে মারামারি হয়েছে। তার ফলে যেখানে যার সাংগঠনিক শক্তি আছে সেখানে এই ধরনের সংঘর্ষ বাধছে। কোনও সন্দেহ নেই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই পরিস্থিতিটাকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছেন। যেভাবে শুরু হয়েছিল তার থেকে আজ পরিস্থিতিটা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আধা সামরিক বাহিনী পাঠানোর যে কথাটা ওঠে সেটা রাজ্য নির্বাচন কমিশন মেনে নেয় এবং রাজ্য সরকারই উল্টে বলে যে আপনারা আধা সামরিক বাহিনী পাঠান। প্রচুর আধা সামরিক বাহিনী এসেছে অতিরিক্ত ৪৮৫ কোম্পানি আরো মোতায়েন হবে ভোটের আগে। তার ফলে সব মিলিয়ে কেন্দ্র রাজ্য রাজনীতি নিয়ে যে একটা বিপুল সংঘাত তৈরি হয়েছে তা নয়। রাজ্যপালও সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন। সব মিলিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগেও অনেকটা অস্থিরতা এবং হিংসা নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। যেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে গেছেন সেখানে অনেকটা হিংসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন। কিন্তু হিংসা মুক্ত পঞ্চায়েত নির্বাচন হচ্ছে সে তো বলা যায় না। বিশেষ করে ভোটের দিন কি হবে সেই আশঙ্কাটা থেকেই যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা হচ্ছে স্টেট সাবজেক্ট।
রাজ্য পুলিশ হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর অধীনে, রাজ্য সরকারের অধীনে। তার ফলে হিংসা হলে কিন্তু দোষটা রাজ্য সরকারের ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। সম্ভবত সেই কারণেই বিজেপি কিন্তু হিংসাকে মূলধন করে তৃণমূল বিরোধী প্রচারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সুতরাং এখানে কিন্তু হিংসার সবথেকে বড় সুবিধাভোগী কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস নয়। এখানে সুবিধাভোগী হচ্ছে বিজেপি। স্বভাবতই তৃণমূলের পক্ষ থেকে বারবার এই কথাটা বলা হচ্ছে আমরা যখন নিশ্চিত যে আমরা জিতব তখন আমরা হিংসা করবো কেন ? হিংসা তারাই করবে যারা জানে যে তারা হেরে যাবে। তারা হিংসার যুক্তি দেখিয়ে তাদের পরাজয়টাকে, গ্লানিটাকে কিছুটা অতিক্রম করার চেষ্টা করবে হিংসার ধুন তুলে। সুতরাং এই অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ চলতেই থাকবে প্রত্যেকটা পঞ্চায়েত নির্বাচনে। পশ্চিমবঙ্গ সেই ইতিহাসের সাক্ষী। কিন্তু দুঃখের বিষয় একটাই সেটা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন হিংসা মুক্ত হতে পারল না। 'জিরো টলারেন্স টু ভায়োলেন্স' বলা হলেও সেই হিংসার ট্রেডিশন কিন্তু অব্যাহত থাকল।