আরও একটি ১৬ অগাস্ট হাজির। দেখতে দেখতে তিন বছর হয়ে গেল দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর (Atal Bihari Vajpeyee) মৃত্যুর। সারা দেশ আজ তাঁর প্রয়ান দিবস বিনম্র চিত্তে স্মরণ করছে। শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। পিছিয়ে নেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ( Mamata Banerjee)। ২০২৪ সালে বিজেপিকে কেন্দ্র থেকে উৎখাত করতে এখন থেকেই কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন তৃণমূলনেত্রী। একুশের বাংলার ভোটে একাই পর্যদুস্ত করেছেন গোটা গেরুয়া ব্রিগেডকে। সেই দলেরই এক নেতার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিন্তু সত্যিই রাজনীতির ময়দানে অনন্য এক নজির।
মমতার অভিভাবক বাজপেয়ী
রাজনীতির ময়দানে একসময় তৃণমূল নেত্রীর অভিভাবক ছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। রাজনীতির বাইরেও অটলজীর সঙ্গে মমতার সম্পর্ক ছিল সর্বজন সুবিদিত। অটল বিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভাতেই প্রথমবার পূর্ণমন্ত্রী হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৯৮ থেকে ১৯৯৯- বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভায় রেলমন্ত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তীকালে এনডিএর সঙ্গে মমতার সম্পর্ক ছিন্ন হলেও, অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক কিন্তু অটুট থেকে গেছিল।
বাজপেয়ীর মৃত্যুতে মমতার চোখে জল
৯৩ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থার চরম অবনতির খবর পেয়ে সেই সময়ে দিল্লি রওয়া দিয়েছিলেন মমতা। দিল্লির বিমান ধরার আগে বিমানবন্দরে স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, "অটলজির মতো মানুষ এখন আর দেখা যায় না। তাঁর সঙ্গে কাজ করাটা সৌভাগ্যের। অনেক স্মৃতি আছে। অনেক কথা মনে পড়ছে।" অটলজীর মৃত্যুর খবর সামনে আসতেই মমতা ট্যুইটে লিখেছিললেন, " বাজেপেয়ীজীর মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত আমি। অটল বিহারী বাজপেয়ী আর আমাদের মধ্যে নেই। তাঁর চলে যাওয়াটা আমাদের দেশের কাছে বড় ক্ষতি। বাজপেয়ীজি-র সঙ্গে আমার কত স্মৃতি, সে সবগুলো আজ বড্ড মনে পড়ছে।"
এনডিএ-র সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হলেও থেকে গিয়েছিল বাজপেয়ীর সঙ্গ সম্পর্ক
১৯৯৮ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এনডিএ-র সঙ্গে ছিলেন মমতা। মাঝে ২০০১ সালে তহলকা কাণ্ডের সময় এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন তৃণমূলনেত্রী। জোট করেন কংগ্রেসের সঙ্গে। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধেই ২০০১ বিধানসভা নির্বাচনে ৬০টি আসন জেতে তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু এরপর ফের অটল বিহারী বাজপেয়ীর ব্যক্তিগত অনুরোধে এনডিএ-তে ফিরে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর ২০০৪ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে ১টি আসন জেতে তৃণমূল। সেবার সাংসদ ছিলেন শুধুমাত্র মমতা। ২০০৬ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-তৃণমূল জোট জেতে ৩০টি আসন। এই সময়ই অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়ে ওঠে।
মমতার বাড়িতে এসেছিলেন বাজপেয়ী
প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন কলকাতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালীঘাটের বাড়িতে গিয়েছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। মমতার মা গায়ত্রী দেবীর হাতে বানানো নাড়ুও খান বাজপেয়ীজি। দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রীর মায়ের সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকে আশীর্বাদ চেয়ে নেন বাজপেয়ী। সে সময়কার রেলমন্ত্রী এমন একচিলতে টালির চালের বাড়িতে যে থাকতে পারেন, তা চাক্ষুষ করেই সে দিন বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর। মমতার প্রতি একটা স্নেহ অটল বিহারী বাজপেয়ীর বরাবরই ছিল। শোনা যায়, সে দিন থেকে মমতার প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন শ্রদ্ধাও যেন জন্মে গিয়েছিল বাজপেয়ীর মনে।
দেশের প্রথম অকংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছরের মেয়াদ সম্পন্ন করেছিলেম বাজপেয়ী। আর সেই বাজপেয়ীকে চিরকাল শ্রদ্ধা করে এসেছেন মমতা ৷ রাজনীতির বাইরেও বাজপেয়ী ছিলেন এক অসাধারণ মানুষ, দৃঢ় ব্যক্তিত্ব। রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা হলেও তাই তাঁর মতই চন্দ্রবাবু নাইডু, নীতীশ কুমার, নবীন পট্টনায়কের মতো আঞ্চলিক দলের নেতারা অটলজির সঙ্গে কাজ করতে পেরেছেন বলেই মত মমতার। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর পারিবারিক সম্পর্কের কথা তাই কখনও চেপে রাখেননি তৃণমূলনেত্রী।
মমতার মতে অটল বিহারী বাজপেয়ী সবসময়ই আঞ্চলিক দলগুলোর খেয়াল রাখতেন। তাঁর কাজ করার ধরণ ছিল আলাদা। বর্তমান বিজেপি নেতাদের মত নয়। তাই বাজরেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তৃণমূল তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে পাশে থেকেছে। শোনা যায় সেই সময় মমতা শুধুমাত্র এনডিএ সরকারে ছিলেনই না, মন্ত্রী হিসেবে তাঁর পছন্দের দফতরগুলোও পেয়েছিলেন। ২০০৪ সালে মমতা মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে চাননি। কিন্তু বাজপেয়ী শেষ পর্যন্ত তাঁকে কয়লা ও খনি মন্ত্রকের দায়িত্ব নিতে রাজি করিয়ে ছিলেন। মমতা নিজেই জানিয়েছিলেন, বাজপেয়ী একবার তাঁর কাছে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কাকে করা যেতেপারে সেই বিষয়ে পরামর্শ চান। তখন তিনিই সর্বপ্রথম এপিজে আব্দুল কালামের নাম প্রস্তাব করেন।
বাজপেয়ী বিরিয়ানি ভালো বাসতেন, গলৌটি কবাব ভালো বাসতেন, কচুরি আর জিলিপিও তাঁর বিশেষ পছন্দের ছিল। তিনি হিন্দিতে দক্ষ আবার উর্দু সায়রী তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। সব মিলিয়ে বিশ্ববরেণ্য এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির প্রতীক। তা সে যতই বিরোধী গেরুয়া শিবিরের হোক না কেন এমন মানুষকে উপেক্ষা করা দায়। শানিত যুক্তি এবং অসামান্য কথনের জন্য দলমত নির্বিশেষে প্রশংসিত ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। বর্তমান বিজেপি নেতাদের সমালোচলা করতে তাই বারবার বাজপেয়ী প্রসঙ্গ টেনেছেন মমতা। কেবল অটলজি নয়, তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, রাজনাথ সিং, নীতিন গড়কড়ি সকলের সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক ছিল মমতার। এখনও নাকি সেই সম্পর্ক অব্যাহত রাজনাথ সিং-এর সঙ্গে।
২০১৯ সালের শেষে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও এনআরসি বিরোধী বিক্ষোভের আগুনে যখন জ্বলছে গোটা দেশ সেই সময় অটলবিহারী বাজপেয়ীর উদ্ধৃতি তুলে ধরে মোদী সরকারকে ‘রাজধর্ম পালনের’ কথা স্মরণ করিয়েছিলেন মমতা। মোদী সরকার কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের পর সেই অটলজিরই স্মরণই নিয়েছিলেন মমতা।
স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মমতা জানিয়েছিলেন যে বাজপেয়ীর যখন তখন খাওয়ার ঘরে ঢুকে পড়ার অনুমতি তাঁর ছিল এবং অনেক সময়তেই দু'জনে একসঙ্গে বসে আহার করেছেন। মাঝে মাঝেই মমতাকে ডেকে পাঠাতেন বাজপেয়ী এবং সেই ডাকে তিনি সাড়া না দিয়ে থাকতে পারতেন না। কখনও কখনও বাজপেয়ীর সঙ্গে গুরত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হত। আবার কখনও কখনও স্রেফ অভিভাবক হিসেবে তাঁকে পিতৃসুলভ পরামর্শ দিতেন বাজপেয়ী।
মমতা বুদ্ধিমতী। তাই তিনি বিজেপির মধ্যে অটল-আডবাণী ও মোদী-শাহ যুগলবন্দী নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "ওঁর (বাজপেয়ী) কাজকর্মের ধারাটাই অন্যরকম ছিল। বর্তমান রাজনীতির সঙ্গে সেই পন্থা কোনও দিনও মিলবে না।" প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর পর বার বার মমতার মুখে অটলের প্রশংসা শোনা গিয়েছে। নানা ধরনের উদাহারণ টেনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বোঝানোর চেষ্টা করেছেন বাজপেয়ীর সঙ্গে বিজেপির বর্তমান নেতৃত্বের বিস্তর ফারাক।