পুজোর চারদিন মায়ের মন্দিরের চারপাশ কড়া নিরাপত্তার বলয়ে মুড়ে ফেলা হয়। মায়ের মন্দিরের পারিপার্শ্বিক এলাকায় নিয়োগ করা হয় আগ্নেয়াস্ত্রধারী বনকর্মীদের।
না, এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে এখানে দেবী দুর্গার দেহে রয়েছে লক্ষ টাকার স্বর্নালঙ্কার। এখানে দেবী দুর্গা নয়, এখানে দেবী পুজিত হন বনদুর্গা রূপে। এখানে বনকর্মীদের নজরদারি চালাতে হয় বন্যপ্রাণীর হামলার হাত থেকে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে। চারদিকে ঘন সবুজ জঙ্গল। জঙ্গলকে মাকড়সার জালের মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে গোটা কয়েক নদী।
নদীগুলোর দুধারে আগমনী বার্তা বহন করছে সাদা কাশের সমারোহ। আকাশের কোলে দোল খাচ্ছে মেঘ শিশুদের দল। এখানে কয়েকটি বনবস্তিতে আদিবাসী মানুষের বসবাস।
এখানের শিশুদেরও দুর্গাপুজার আনন্দে মেতে উঠতে ইচ্ছে হয়। আর তাই ৪০ বছর আগে গ্রামের মানুষ এবং বনকর্মীরা মিলে শুরু করেছিলো দেবী বনদুর্গার আরাধনা। তবে আদিবাসী সমাজের এই পূজায় মা উমা রূপে নয় এখানে মা পুজিত হন বনদুর্গা রূপে।
জঙ্গলের রীতি রেওয়াজ মেনে বন্যপ্রাণীদের বিরক্ত না করতে এখানে মাইক বাজে না। বনদুর্গার আরতিতে শুধুমাত্র একটি ঢাক বাজে। তাও মৃদুশব্দে। বনদুর্গার এই পুজোয় অষ্টমির অঞ্জলি দিতে ভিড় জমায় দেশ-বিদেশের পর্যটকরা। আলিপুরদুয়ার জেলা শহর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের অন্তর্গত চিলাপাতার গহন জঙ্গলে বানিয়া নদীর তীরে এই বনদুর্গার পুজার প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে।
জঙ্গলের ভিতরে গা ছমছম করা পরিবেশ এই পুজোর যৌথ উদ্যোক্তা চিলাপাতা ফরেস্ট রিক্রিয়েশন ক্লাব ও স্থানীয় নব যুবক ক্লাব। আজ থেকে ৪০ বছর আগে বনদপ্তরের চিলাপাতা রেঞ্জের বনকর্মীরা এবং স্থানীয় আদিবাসী মানুষরা মিলে বনদুর্গার এই পুজার সূচনা করেছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসী সমাজ ও চিলাপাতার বনকর্মীদের এই পুজা গোটা উত্তরবঙ্গে বনদুর্গা পূজা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
চিলাপাতা জঙ্গল লাগোয়া কুরমাই, আন্দু, দেওগাঁও, রাভাবস্তি, উত্তর শিমলাবাড়ি ও চাকোয়াক্ষেতি বনবস্তিবাসীদেরও পুজা হয়ে উঠেছে। জেলা শহরে গিয়ে পুজো দেখতে পারেন না চিলাপাতা রেঞ্জের বন কর্মী ও বনবস্তির বাসিন্দারা। এই সমস্যার জন্যই আরণ্যক পরিবেশে রেঞ্জ অফিসেই মায়ের পুজো করার সিদ্ধান্ত নেন আদিবাসী সমাজ।
স্থানীয় জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষেরা চিলাপাতার এই পুজোকে বনদুর্গার পুজা হিসাবেই দেখেন। ঢাক ও মাইকের শব্দে বন্যপ্রাণীদের অসুবিধার কথা ভেবে বনদপ্তর অতীতে বনদপ্তর একবার এই পুজো বন্ধ করে দেওয়ার ফতোয়া জারি করেছিল। পরে বনকর্মীদের পরিবার ও বনবস্তিবাসীরা ফুঁসে ওঠায় এই ফতোয়া তুলে দেওয়া হয়। পুজো কমিটির সভাপতি স্বয়ং চিলাপাতা রেঞ্জের রেঞ্জার সন্দীপ দাস।
পুজা কমিটির সম্পাদক বনকর্মী রবি সোম বলেন, বন্যপ্রাণীদের অসুবিধার কথা ভেবে এবার আর মাইক বাজানো হবে না। তবে ঢাক বাজানো হয়। যদিও ঢাকের আওয়াজ কম রাখা হয়। আধার নামার পর সেই ঢাকের আওয়াজও পুরোপুরি বন্ধ করে রাখা হয়। বন্যপ্রাণীর হামলা রুখতে পুজার কয়েকদিন পুজা মণ্ডপের দিকে কঠোর নজরদারিও রাখা হয়।
প্রতি বছর পুজার সময় চিলাপাতার জঙ্গলে আসা পর্যকরা এখানেই অষ্টমীতে অঞ্জলি দেয়। পুজার সময় বেড়াতে এলে বিদেশি পর্যটকরাও অঞ্জলি ও পুজার আনন্দে মেতে উঠে। বনদপ্তরের রেকর্ডে আছে, ২০০১ সালে এখানে তিন জন জার্মান পর্যটক অষ্টমীতে মায়ের অঞ্জলি দিয়েছিল। বিদেশী পর্যটকরা মায়ের আশীর্বাদও নিয়েছিল। চিলাপাতার আরণ্যক পরিবেশে বনদুর্গার পুজোর অষ্ঠমীর অঞ্জলীর এই ইতিহাস আজও অমলিন।
শুধু বনকর্মীদের পরিবারই নয়। এই পুজোর আয়োজনে হাত লাগায় বনবস্তিবাসীরাও। তবে পুজার সমস্ত খরচ বহন করে বনকর্মীরাই। চাঁদার জন্য বনবস্তিবাসীদের জোর করা হয় না। চিলাপাতা জঙ্গলের এই বনদেবীর পুজোর বড় আকর্ষণ সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর সন্ধ্যায় লোকায়ত রাভা কৃষ্টির নৃত্য ও সংস্কৃতির মুর্চ্ছনা। সঙ্গে আদিবাসীদের ধামসা মাদলের মৃদু তালের সঙ্গে হাঁড়িয়ার ঝিমুনিতে কোমর দোলানো নাচ। যা রাতের আরণ্যক পরিবেশে প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে যায় গহন জঙ্গলের বুক চিরে।
কিন্তু করোনার জেরে এবার সেই নাচগানের অনুমতি মিলবে কিনা বনবস্তিবাসীর তা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না। পুজা কমিটির সম্পাদক রবিবাবু বলেন, এনিয়ে এখনও কোন নির্দেশিকা আসেনি। এখানে চিরাচরিত সাবেকিয়ানা ও নিষ্ঠা সহকারেই মায়ের পুজো হয়। ট্রাকে চাপিয়ে জঙ্গলের রাস্তা ধরে মায়ের মূর্তি আসে আলিপুরদুয়ার জেলা শহর থেকে। পুজোর পর বনবস্তিবাসীরা শোভাযাত্রা করে মায়ের বিসর্জন স্থানীয় বানিয়া নদীতে।