লতা মঙ্গেশকর আর নেই। কোভিডের এক ছোবলে শেষমেষ টানা কয়েক মরশুম লড়াই করে হার মানলেন সুর সম্রাজ্ঞী। ভারতের স্বর কোকিলা বা নাইটিঙ্গেল চিরদিনের মতো ইহলোক ত্যাগ করলেন। তাঁর সুরের সাম্রাজ্য সঙ্গে নিয়েই সাদাসিধা সংযম এবং শান্ত জীবন যাপন করা অবিবাহিত লতা দিদি অবশেষে চিরদিনের মতো শান্ত হলেন।
২০২০ কোভিড মহামারীর পর থেকে লতা দিদির মানুষের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রায় মুম্বইতে মহামারীর প্রকোপ এবং লতা দিদির বৃদ্ধাবস্থাতে অত্যন্ত জরুরিভাবে এই বিচ্ছেদ প্রয়োজন ছিল। তিনি সমস্ত রকম কোভিড বিধি মেনে গৃহবন্দী করে নিয়েছিলেন নিজেকে।
৯০ বছর বয়সের পর থেকে লতা মঙ্গেশকরের শারীরিক অবস্থা কমজোর হতে শুরু করে। তিনি বিভিন্ন বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হন। যা কোভিডের সময়ে তীব্র আকার ধারণ করে তারপরও তিনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মুম্বইয়ের ঠান্ডা এবং কোভিড এর প্রকোপ কিছুতেই কমছিল না।
এই কারণেই গত এক বছর থেকে লতা মঙ্গেশকর খুব ঘনিষ্ঠ দু'একজন ছাড়া প্রায় মানুষের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যা যোগাযোগ ছিল সমস্ত টেলিফোনেই। তিনি নিজের ঘরে সেলফ কোয়ারেন্টাইন এ ঢুকে গিয়েছিলেন। শরীর কমজোরি তো ছিলই, পাশাপাশি তার নিজস্ব বার্ধক্যজনিত রোগ তাকে আরও স্থবির করে দিয়েছিল। বয়স বাড়ছিল। শারীরিক অসুস্থতা তীব্র হচ্ছিল।
CID ফেম ঋষিকেশ পান্ডেj সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের একটি পৃথক সম্পর্ক ছিল। গত ১৫ বছর থেকে এসে গিয়েছিল। তার ফ্যামিলি ফ্রেন্ডের মত হয়ে গিয়েছিলেন। ঋষিকেশ জানিয়েছেন যে লতা দিদির শারীরিক পরিস্থিতির মাথায় রেখে গত বছর তার ঘরে কোন বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এমনকী আশা ভোঁসলেও দেড় বছর থেকে লোনাভালা থাকলেও সেখান থেকে মাত্র দুবার মুম্বাইতে এসেছিলেন।
১০ বছরে থেকে লতা শারীরিক পরিস্থিতির বার্ধক্যজনিত কারণে ভেঙে পড়েছিল। তাঁর শারীরিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে নার্সিং স্টাফ রাখা হয়েছিল। পাঁচ থেকে ছয় জন নার্স তাকে দেখভাল করতেন। লতাজির ডায়েট চার্টে লম্বা সময়ের ডাক্তারদের পরামর্শে হালকা খাবারই দেওয়া হতো। খাওয়া-দাওয়া গত বছর ধরে সাদা এবং সংযমী ছিল।
লতাজির ঘরে পরিবেশ ছিল ধার্মিক। ঘরে ঢুকলেই বাঁদিকে একটি সুদৃশ্য মন্দির রয়েছে। যেখানে পূজা পাঠ চলত। ঘরের পরিস্থিতিতে আধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক ছিল। প্রতিবছর গণপতি পূজাতে আমরা লতা দিদির ওখানে যেতাম। কিন্তু করোনার কারণে গত দু'বছর ধরে সেখানে যাতায়াত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তিনি জানিয়েছেন যে, দিদির ঘরে টাকা গণপতি পূজা হয়েছিল। কিন্তু আমরা তাতে সামিল হতে পারিনি। এমন নয় যে কোন ঘোষিত প্রতিবন্ধকতা ছিল, কিন্তু আমরা সবাই করোনার কারণে এবং লতা দিদির শারীরিক পরিস্থিতির মাথায় রেখে পুজায় শামিল না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
হোয়াটসঅ্যাপ একটিভ ছিলেন লতা মঙ্গেশকর
হৃষিকেশ জানিয়েছেন যে লতাজি যদি ওর শারীরিকভাবে লোকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন, না তবে তিনি মোবাইল হোয়াটসঅ্যাপে সবসময় সক্রিয় থাকতে দেখতেন। টিভি তিনি কাছের লোকদের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছিলেন এবং একাধিক গ্রুপে তিনি থাকতেন এবং সব সময় প্রশ্নের উত্তর দিতেন এবং কথাবার্তা চালিয়ে যেতেন। বিভিন্ন মজাদার জোকস তিনি পছন্দ করতেন পছন্দ হলে সেটি অ্যাপ্রিশিয়েট করে পাল্টা রিপ্লাই করতেন।
লতা সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল তিনি কারও কোন কাজ পছন্দ হলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে তা সাধুবাদ জানাতে এবং প্রশংসা করতেন। তার হাঁটুর বয়সী কেউ হলেও তিনি প্রশংসা করতে পিছপা হতেন না এবং তাঁর মৃত্যু অবধি স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। তিনি যাকে পছন্দ করতেন তার সমস্ত বিষয় ফলো করতেন সে বিভিন্ন জগতের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল।
ঋষিকেশ জানিয়েছেন যে আমি তো অবাক হয়ে যেতাম যে যখন তিনি আমাকে বলেন যে সিআইডিতে আমি কোন রঙের শার্ট পরেছিলাম এবং কি ধরনের বেল্ট লাগিয়ে ছিলাম তার অপার স্নেহ আমার প্রতি ছিল এবং আমি তার সঙ্গে অনেক স্মৃতি তে জড়িত ছিলাম। এখন সব শেষ। সব এখন ইতিহাসের পাতায়। আমার মনের মনিকোঠায় থেকে যাবে। দিদিকে হারানো আমার কাছে ব্যক্তিগত ক্ষতি।
লতা মঙ্গেশকর অনেকবারই এমন বলেছিলেন যে যখন সব ঠিক হয়ে যাবে তখন দেখা করা যাবে একবার সবাই মিলে ডিনার করবো। আফশোস যে আমাদের পৃথিবীতে ওই দিন আর আসবেনা লতা দিদির সঙ্গে আর কখনওই ডিনার বা লাঞ্চে দেখা হবে না। ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেই তিন দিন আগে মেসেজ এসেছিল যে লতা দিদি এখন ভেন্টিলেটর থেকে বাইরে এসেছেন এবং তার পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। আচমকা স্থিতি বিগড়ে যাওয়ার পর তাকে আবার ভেন্টিলেশনে দুদিন আগে ভর্তি করা হয়েছিল।