ভূত আছে না নেই তা শীতের দুপুর কিংবা বর্ষার রাতের আড্ডার বড় আলোচ্য বিষয়। এমন কখনো হয়েছে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। আর ঘুম আসছে না। হঠাৎ খোলা জানালার দিকে চোখ গেলো। ওপাশে যেন একটা সাদা ছায়া নড়ে উঠতে দেখা গেল। সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো, ওটা ভূত নাতো? মনে হচ্ছে যেন কেউ হেঁটে হেঁটে কাছেই আসছে। তারপর সারারাত চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে কেটে গেল। এভাবেই ফাকা বাড়িতে সারাটা রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই আছে।
ভূত, অশরীরী, প্রেত। এই সব শব্দের সঙ্গে কমবেশি সকলেই আমরা পরিচিত। ছোটবেলায় দাদু-ঠাকুমার মুখে আমরা সকলেই ভূতের গল্প শুনেছি। কিন্তু, সেই গল্প শোনার পর যা হত, তা নিশ্চয়ই মনে আছে। নিজের শান্ত বাড়িটিকেই তখন মনে হত ভূতের আখড়া। অনেকেই ভূতে ভয় পায় কিন্তু, ভূতের সিনেমা দেখতে ছাড়ে না।
কেউ ভূতে বিশ্বাস করে, কেউ আবার খুব জোরের সঙ্গে বলে ভূত বলে কিছু নেই। ভূতে ধরা নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। হিন্দু শাস্ত্রে তো আবার ভূত চতুর্দশীও রয়েছে। দীপান্বিতা অমাবস্যার আগে চতুর্দশী তিথিতে হিন্দু মতে ভূত চতুর্দশী পালন করা হয়। হিন্দু মতে বিশ্বাস করা হয় যে এদিন মৃত পূর্ব পুরুষরা মর্ত্যে নেমে আসেন৷ তাঁদের খুশি করতে ও অতৃপ্ত আত্মাদের অভিশাপ থেকে বাঁচতে এদিন নানা আচার পালন করার প্রথা রয়েছে। অনেকটা ভূত চতুর্দশীর মতোই পশ্চিমী দুনিয়ায় হ্যালোউইন পালন করা হয়। যুগ যুগ ধরে অনেকেই ভূতের অস্তিত্ব টের পেয়েছেন! অনেকে খোদ বাড়িতেই ভূতের ভয়ে পেয়েছেন!
জ্যোতিষ মতে কাদের ভূতে ধরে?
খুব সাধারণ ভাবে বললে বলা যায়, যাদের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে জন্ম, আর চন্দ্র খুব দুর্বল ভাবে বৃশ্চিক রাশিতে থাকে, কালসর্প যোগ থাকে এবং লগ্ন ও সপ্তম এই অক্ষে রাহু-কেতু অবস্থান করে, তা হলে তাদের ভূতে ধরার সম্ভাবনা প্রবল।
অনেকেই দাবি করেন যে, তাদের চারপাশে আত্মা বা অশরীরীর অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ রয়েছে। কিছুজন আবার নিজের বাড়িতে ভূতের উপস্থিতিও দাবি করেন। সাধারণত, যখন বাড়ি তৈরির জন্য নতুন জায়গা বা পুরানো কোনও বাড়ি কেনা হয়, তখন এই জাতীয় সমস্যা বেশি দেখা যায়। যাকে বলে বাস্তুদোষ। এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই জাতীয় ঘটনা আকছার ঘটে। আবার নতুন খালি জায়গায় বাড়ি করার আগে সেই জায়গা সম্বন্ধে ভালো ভাবে খোঁজ খবর না নিয়ে বাড়ি করলে এই জাতীয় সমস্যায় পড়তে হয়। কিন্তু কীভাবে বুঝবেন, বাড়িতে তেঁনারা রয়েছেন ?
আজ আমরা আপনাকে কয়েকটি লক্ষণ সম্পর্কে বলব, যেগুলি দেখে আপনি বুঝবেন আপনার বাড়িটি ভুতুড়ে কি না -
হঠাৎ তাপমাত্রার পরিবর্তন
বাড়িতে ভূত আছে কি না তা নিশ্চিত করতে আপনি বাড়ির তাপমাত্রা বা কোনও নির্দিষ্ট ঘরের তাপমাত্রার দিকে মনোযোগ দিতে পারেন। আপনি যদি কোনও কারণ ছাড়াই হঠাৎ বাড়ির তাপমাত্রায় পরিবর্তন অনুভব করেন, তাহলে আপনার বাড়িতে আত্মা থাকতে পারে। কারণ, তারা কোনও এলাকায় প্রবেশের সাথে সাথে কিছু শক্তি পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করে, বিশেষত তাপ। তাই, হঠাৎ বাড়ির কোনও একটা ঘরে বা ওই এলাকায় হঠাৎ করে প্রচণ্ড ঠান্ডার অনুভূতি হতে পারে।
নানা ধরনের আওয়াজ
এই ধরনের বাড়ির কোনও ঘর বা চিলেকোঠা থেকে নানা ধরনের আওয়াজ, শব্দ, যেমন, ধস্তাধস্তির আওয়াজ, কাচের বাসনপত্র মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেলে যেমন শব্দের সৃষ্টি হয় তেমন শব্দ, দরজা বন্ধ বা খোলার আওয়াজ, কারও হেঁটে যাওয়ার আওয়াজ, হাসির আওয়াজ— এই রকম নানা রকম শব্দ শোনা যায়। অথচ যেখান থেকে শব্দ আসছিল সেখানে পৌঁছনোর পর সে রকম কিছুরই হদিস পাওয়া যায় না।
গলার স্বর এবং গন্ধ
হঠাৎ করেই বিশ্রী গলার স্বর বা অচেনা গন্ধ পেতে পারেন। ফিসফিস করে কথা বলা, হাসির আওয়াজ শুনতে পারেন। আপনি কোনও ফুল, তামাক, আতর ইত্যাদির গন্ধ পেতে পারেন, যা আপনার বাড়িতে ব্যবহৃত হয় না। অদ্ভুত গন্ধ পাবেন, যা কয়েক সেকেন্ড বা কয়েক মিনিট স্থায়ী হতে পারে। এগুলি ভুতুড়ে ঘরে বাস করার দৃঢ় লক্ষণ হতে পারে।
নির্জীব বস্তুগুলির অদ্ভুত ভাবে চলাফেরা
এটা ঠিক যে, বাহ্যিক শক্তি প্রয়োগ না করা হলে নির্জীব বস্তুগুলি নিজেরা চলাফেরা করতে পারে না। কিন্তু, হয়ত আপনি হঠাৎই খেয়াল করবেন যে, বাড়িতে কেউ নেই অথচ জিনিসপত্র বা আসবাবপত্রের স্থান পরিবর্তন হয়ে আছে। আপনার চেয়ারটি আপনি গতবার যে জায়গায় রেখেছিলেন সেখানে নেই। খেলনা, বই, ডায়েরি, আসবাব বা কোনও ফটো ফ্রেমের মতো প্রাণহীন জিনিসগুলি বারবার স্থান পরিবর্তন করছে। আবার এও দেখা যায়, বাড়িতে কেউ নেই অথচ ইলেকট্রিক লাইটগুলি জ্বলছে আর নিভছে। এগুলি দেখলে বুঝবেন যে আত্মা সেখানে অবস্থান করছে। এছাড়াও, পায়ের শব্দও পেতে পারেন।
পোষ্য প্রাণীর অদ্ভুত আচরণ
আপনার যদি পোষা কুকুর বা বিড়াল থাকে তবে আপনি তাদের আচরণ লক্ষ্য করুন। আপনার পোষ্য কুকুরটি কি অদ্ভুত ভাবে কোনও কিছু লক্ষ্য করে চিৎকার-চেঁচামেচি করছে? আপনার বিড়াল কি প্রতিনিয়ত অদেখা কিছু দেখছে? আপনার পোষা প্রাণী কি ঘরে প্রবেশ করতে ভয় পাচ্ছে?তাদের অস্বাভাবিক আচরণই আপনার ঘর ভুতুড়ে হওয়ার একটি চিহ্ন। কারণ, প্রাণীরা এমনকিছু দেখতে ও শুনতে সক্ষম করে যা মানুষ পারে না। বাড়িতে অশরীরি আত্মার উপস্থিতি থাকলে আচমকাই বাড়ির পোষ্য যেমন কুকুর, বেড়াল বা টিয়ার মৃত্যু হয়।
মাঝেমাঝেই কোনও কিছু দেখা বা স্পর্শের অনুভূতি
হঠাত্ই আপনার মনে হল, পিছন থেকে কেউ আপনার কাঁধ বা পিঠ স্পর্শ করল। ফিরে দেখলেন, কেউ নেই। প্রথমে নিশ্চিত হোক কেউ আপনার সাথে মশকরা কিংবা ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে কি না। যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে সাবধান! আপনাকে স্পর্শকারী রক্তমাংসের কোন জীব না-ও হতে পারে!
বিভিন্ন দাগ
বাড়ির দেওয়ালে নানা ভাবে বিশ্রী রকম আঁচরের দাগ, বা কাঠের আলমারি বা কাঠের কোনও আসবার পত্রে খোদাই করা কোনও বিকৃত ছবি।
নতুন বাড়িতে ওঠার আগে ভালো করে খোঁজ নিন
নতুন বাসায় পা রেখে যদি শোনেন, সেখানে কেউ আগে মারা গিয়েছেন অথবা যে জমিতে বাড়ি করেছেন, সেটি আগে কবরখানা কিংবা শ্মশানঘাট ছিল, তাহলে ভয় পাবেন না। মৃত্যু একটা কমন বিষয়। তা কোথাও ঘটে থাকলেই যে প্রেত কিলবিল করবে, এমন কোনও কথা নেই। তবে বলা হয়ে থাকে যে পাপি ব্যক্তিদের আত্মা তার কবরস্থানের আশে পাশেই ঘোরাঘুরি করে। যদি আপনার বাসস্থানের স্থানটিতে কোন পাপি ব্যাক্তিকে কবর দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে তার অতৃপ্ত আত্মা সেখানে ঘোরা ফেরা করাই স্বাভাবিক। অতএব নতুন বাড়িতে ওঠার আগে ভালো করে খোঁজ নিন।
উপরিউক্ত কারণগুলি ছাড়াও আরও অনেক কারণ আছে বাড়িতে ভূত থাকার। তবে, এই কারণগুলিই বেশি দেখা যায়।
ভূত আছে কী নেই এই তর্ক চলছিল, চলছে চলবে। বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে ভূতের অস্তিত্ব বিপন্ন করা একদমই উচিত হবে না। কলকাতা শহরেও ভূতের অনুভূতি বা অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছেন অনেকেই। সে ন্যাশনাল লাইব্রেরি হোক বা হেস্টিং হাউস, আর রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন হোক বা মহাকরণ, তেনাদের গতিবিধি অবাধ। সম্প্রতি শোনা গিয়েছে জোড়াবাগান ট্র্যাফিক গার্ডে হানা দিয়েচে ভূত! ভূতের উপদ্রবে ঘুম ছুটেছে কলকাতা পুলিশের ট্রাফিক গার্ডের।যার জন্য ময়দানে নামতে হয়েছে দুঁদে গোয়েন্দাদের। উত্তর কলকাতার সাবেক বাড়ি ভাড়া নিয়ে লালবাজার পুলিশ ট্রাফিক গার্ডের বারাক বানিয়েছে। ১৯৭১-৭২ সাল থেকে পুলিশ ওই বাড়িতে রয়েছে। এতদিন সেখানে ভূতের গল্প শোনা যায়নি, হঠাৎ রাজকীয় সেই বাড়িতেই ভূতের হানা।
ভূত আছে কি না জানি না, কিন্তু ভূতের ভয় তো আছে। সব মানুষের মধ্যেই সেই ভয় আছে। আর পুরনো বাড়িতে কড়িবর্গা, বিশাল গোলাকৃতি থাম, খড়খড়ির জানালা আর চওড়া দেওয়ালের স্থাপত্য, একটু গা-ছমছম ব্যাপার থাকবেই। যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্করা সর্বদাই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ভূতের অস্তিত্বে। তারা বার বার বলেছেন, ভূত যে রয়েছে, তার প্রমাণ কোথায়? এর উত্তরে ভূতবাদীরা পাল্টা প্রশ্ন করেছেন সে যে নেই, তার প্রমাণটাই বা কই? এহেন চাপান উতোরে কেটে গিয়েছে অনেক সময়। কিন্তু পরীক্ষাগারে বিস্তর সময় খরচ করে ভূতের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব প্রমাণের গুরুদায়িত্বটি পালনে আগ্রহ দেখাননি তেমন কেউ।