রাজ্যে তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরে শুরু বিজেপিতেই ভাঙন নয়, সব বিরোধীদলেই ভাঙন ধরাতে তৎপর হয়ে উঠেছে তৃণমূল কংগ্রেস । ইতিমধ্যেই নিচুতলায় বামদল এবং কংগ্রেস থেকে নেতা-কর্মীরা যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। এবার তৃণমূলে যোগ দিলেন প্রণবপুত্র।
শেষ পর্যন্ত সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে তৃণমূলে যোগ দিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ছেলে প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় । সোমবার বিকেলে তৃণমূল ভবনে গিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে জোড়াফুল শিবিরে যোগ দেন তিনি। যোগদান পর্বে ছিলেন, তৃণমূলের মহাসচিব তথা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্য়ায় এবং লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
তৃণমূলে যোগ দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অভিজিৎ বলেন, ‘‘বিধানসভা ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমাণ করেছেন তিনি বিজেপি-কে রুখতে পারেন।" কার্যত একুশের ভোটের পর থেকে বেসুরো বাজছিলেন অভিজিৎ। ভোটে দলের ভরাডুবি নিয়ে প্রশ্নও তুলেছিলেন তিনি।
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের পর প্রধান বিরোধি দলের তকমা পাওয়া হাত শিবির এবার খালি হাতে ফিরেছে। দলের এই শোচনীয় পরাজয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি-পুত্র তথা জঙ্গিপুরের প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়।
বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের ভরাডুবির পরে একাধিক বার অভিজিতের দলবদল নিয়ে জল্পনা হয়েছে। যদিও প্রতি বারই জোড়াফুল শিবিরের যোগদানের সম্ভাবনা খারিজ করেছিলেন তিনি। প্রাক্তন সাংসদ অভিজিৎ সম্প্রতি তাঁর নির্বাচনকেন্দ্র জঙ্গিপুরে গিয়েছিলেন। সেখানেও তাঁর সঙ্গে দেখা গিয়েছিল মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূলের নেতাদের। যদিও সেই সময় অভিজিৎ বলেছিলেন, ‘আমি এখনও কংগ্রেসে রয়েছি। খবর রটেছে যে আমি তৃণমূলে যোগ দিচ্ছি। এটা ঠিক নয়।’ বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের প্রচার কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে কাজ করেছেন লোকসভার প্রাক্তন এই সাংসদ।
গত ২১ জুন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন অভিজিৎ। পরে তিনি এই বিষয়ে কিছু না জানালেও তাঁর ঘনিষ্ঠমহল বৈঠকের কথা স্বীকার করে নিয়েছিল। অভিজিতের ঘনিষ্ঠ এক নেতা জানিয়েছিলেন, তৃণমূলে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে। অভিষেকের সঙ্গে সাক্ষাতের দিন দশেক আগে জঙ্গিপুরে গিয়ে সাংসদ ও তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ জেলা সভাপতি আবু তাহের, সাংসদ খলিলুর রহমান, দুই মন্ত্রী আখরুজ্জামান ও সাবিনা ইয়াসমিন, বিধায়ক ইমানি বিশ্বাস, প্রাক্তন বিধায়ক আমিরুল ইসলাম ও মহম্মদ সোহরাব-সহ তৃণমূলের অনেক নেতা-নেত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছিলেন অভিজিৎ।
কংগ্রেসের টিকিটে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে দু’বার সাংসদ হয়েছিলেন অভিজিৎ। তার আগে হয়েছিলেন বীরভূমের নলহাটির বিধায়ক। অভিজিৎ সোমবার সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, ‘‘আমি এখন শুধুই প্রাক্তন। কোনও পদ আমার নেই।’’ পাশাপাশি, প্রণব-পুত্র বলেন, ‘‘বাবা আমাকে কখনওই কংগ্রেসে যোগ দিতে বলেননি। আমার নিজস্ব সিদ্ধান্তে রাজনীতিতে এসেছিলাম।’’
২০১১ সালে কংগ্রেসের হয়ে রাজনীতির আসরে নামার আগে তিনি স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া লিমিটেডের কর্পোরেট সোস্যাল রেসপন্সসিবিলিটির জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ভারত হেভি ইলেকট্রিকাল লিমিটেড, মারুতি উদ্যোগ লিমিটেড, স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া লিমিটেডের মত নামিদামি সংস্থায় কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ হিসাবে কাজ করেছেন।
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের তিন সন্তানের মধ্যে দু'জন রাজনীতির আঙ্গিনায় পা রেখেছিলেন। প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন কংগ্রেসের স্তম্ভ। তিনি প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর নম্বর-টু ছিলেন। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়েরও নম্বর-টু ছিলেন প্রণববাবু। আবার সেই মানুষটিই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহেরও নম্বর-টু হয়েছিলেন। অনেকে বলতেন ভারতীয় রাজনীতির তিনি হলেন পারপিচুয়াল নম্বর টু। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দল ছাড়লেও তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় ছিল প্রণববাবুর।
শোনা যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পিসি বলেন অভিজিৎ। বাবার মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে বড় ছেলে অভিজিৎ দল ছাড়লেন। অনেকের মতে কংগ্রেসের রাজনীতিতে কোনও ভবিষ্যৎ না দেখেই অন্য পথে হাঁটলেন প্রণব পুত্র।
রাজীব গান্ধীর জমানায় একবার কংগ্রেস ছেড়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তবে বরাবর নিজের দলের প্রতি ছিলেন নিষ্ঠাবান। কংগ্রেসের ইতিহাস নিয়ে একাধিক বইও লিখেছিলেন। দাদার এই দলবদল নিয়ে ট্যুইটারে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন বোন শর্মিষ্ঠা। লিখেছেন দুঃখজনক। তবে প্রণবাবুর মৃত্যুর পর বড় ছেলে ও মেয়ের মধ্যে বিবাদ প্রকাশ্যে আসে। বাবার বই প্রকাশ নিয়েই তুমুল ঝামেলার সূত্রপাত।
মনে করা হচ্ছে যে, জঙ্গিপুর আসন থেকে অভিজিৎকে টিকিট দেওয়া হতে পারে তৃণমূলের তরফ থেকে। রাজ্যের যে বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে উপনির্বাচন হবে, তার মধ্যে একটি হল জঙ্গিপুর। এর আগে ২০১২ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি হলে জঙ্গিপুর আসন থেকে পদত্যাগ করেন। উপনির্বাচনে সেই আসন থেকে জিতে লোকসভায় গিয়েছিলেন অভিজিৎ। পরে ২০১৪ সালেও জয় পান তিনি। কিন্তু ২০১৯ সালের নির্বাচনে তিনি হেরে যান।