
কলকাতার নিউটাউনে আজ দুর্গাঙ্গনের শিলান্যাস করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২৬১.৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প। সুবিশাল মন্দির। বছরভর অধিষ্ঠিত থাকবেন দুর্গা। যার নির্যাস, কলকাতায় সারাবছর দুর্গাপুজোর আমেজ আনার চেষ্টা। ওদিকে দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের জনপ্রিয়তাও তুঙ্গে। সরকার ডেটা বলছে, ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত, মাত্র ১০ মাসেই দিঘার জগন্নাথ মন্দিরে ১ কোটি দর্শনার্থীর ভিড় হয়েছে। ছাব্বিশের ভোটের আগে জগন্নাথ ও দুর্গা শরণে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কেন নিউটাউনে দুর্গাঙ্গন ও দিঘায় জগন্নাথ মন্দির?
এখন প্রশ্ন হল, জগন্নাথ মন্দির গড়তে কেন দিঘাকেই বেছে নিলেন মমতা? আবার দুর্গাঙ্গন গড়তে কেন কলকাতার নিউটাউন? দিঘায় জগন্নাথ মন্দির গড়তে আড়াইশো কোটি টাকা খরচ করেছে রাজ্য সরকার। নিউটাউনে দুর্গাঙ্গন গড়তে প্রায় ২৬২ কোটি টাকা খরচ করছে মমতার সরকার।
প্রথমে দুর্গাঙ্গন প্রসঙ্গে আসা যাক। আজ নিউটাউনে সুবিশাল দুর্গাঙ্গন প্রকল্পের শিলান্যাস। ১৭ একর জমিতে তৈরি হচ্ছে এই প্রকল্প। দুর্গাঙ্গন তৈরির এই সিদ্ধান্তের পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে উঠে আসছে, বিজেপি-র হিন্দুত্ব রাজনীতির পাল্টা চাল। ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সহ বিজেপি নেতাদের মুখে শোনা গিয়েছে, 'জয় মা কালী' স্লোগান। ২০২১ সালে জয় শ্রীরাম স্লোগানে বাংলায় খুব একটা লাভ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালিরা বেশির ভাগই শাক্ত। অর্থাত্ কালী শক্তির উপাসক। তাই রামের প্রতি সেই আবেগ বা ভক্তি বিশেষ চোখে পড়ে না।
বিজেপি-র 'জয় মা কালী'র পাল্টা
বিজেপি যখন এই কৌশল নিচ্ছে, তখন 'জয় মা দর্গা'কে পাল্টা হাতিয়ার করলেন মমতা। মমতার এই মন্দির তৈরির স্ট্র্যাটেজির খোলাখুলি বিরোধিতাও করতে পারছে না বিজেপি। তাহলে স্ববিরোধ হয়ে যাবে। আবার কলকাতার দুর্গাপুজো UNESCO হেরিটেজ তালিকাতেও রয়েছে। ফলে কলকাতা ও বাঙালির দুর্গাপুজোর আবেগকে কাজে লাগানোর স্ট্র্যাটেজি মমতা নিলেন। কলকাতার দুর্গাপুজোকে যে ভাবে ব্র্যান্ডিং করা হয়, বাংলার অন্যান্য জেলাগুলির দুর্গাপুজোকে সেই ব্র্যান্ডিং করা হয় না বহু বছর ধরেই। সেই বামল থেকেই। তাই মমতার এই সিদ্ধান্তে, এক ঢিলে দুই পাখি নিশানা। কলকাতাকে বছরভর দুর্গাপুজোর আমেজে রাখতে ও দুর্গাপুজোকে হাতিয়ার করে নরম হিন্দুত্বের ইমেজটাও ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট মমতা। রাজনৈতিক শত্রুর অস্ত্রেই শত্রুকে বিনাশের পন্থা।
এবার আসা যাক, দিঘার প্রসঙ্গে। দিঘায় জগন্নাথ মন্দির, নাকি ধাম, তা নিয়ে বিতর্কের মধ্যেও ভোটব্যাঙ্কের সমীকরণটা বেশ স্পষ্ট। ওড়িশা একদা বাংলার মধ্যেই ছিল। ১৯৩৬ সালে ওড়িশাকে পৃথক প্রদেশ করে দেয় ব্রিটিশরা। ওড়িশাবাসী বা ওড়িয়া ভাষার জনগণের কাছে জগন্নাথ বিরাট আবেগ। ওড়িশার সামাজিক পরিচিতির সঙ্গেও ওতোপ্রোত ভাবে জড়িয়ে।
ওড়িয়া ও বাঙালির বিরোধ বহু প্রাচীন
বাঙালি ও ওড়িয়া সম্প্রদায়ের বিরোধ বহু প্রাচীন। আগে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিরোধ ছিল, তা মূলত অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন সেই বিরোধ অনেক বেশি তীব্র হয়ে উঠেছে। এর ফলে এমন এক উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেখানে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি সহজেই সক্রিয় হয়ে উঠতে পারছে। দিঘায় নতুন মন্দিরকে ‘ধাম’ বলার বিরোধিতা আসলে জগন্নাথকে ঘিরে গড়ে ওঠা ওড়িয়া পরিচয়ের হিন্দু দিকটিকে আবার জোরালোভাবে সামনে এনেছে। পুরীকে ধাম বলা হয় এই বিশ্বাস থেকে, হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ধারার অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি আদি শঙ্করাচার্য পুরীকে ধাম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। বলা হয়, তিনিই মন্দিরে কাঠের জগন্নাথ মূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং একই সঙ্গে সেখানে গোবর্ধন মঠ প্রতিষ্ঠা করেন, যা শঙ্করাচার্যের আসন হিসেবে পরিচিত।
এই বিতর্ককে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে জগন্নাথ ও ওড়িয়া পরিচয় নিয়ে চলা বিশেষ রাজনৈতিক আলোচনার প্রেক্ষাপটেও নজর দিতে হয়। ওড়িশায় ক্ষমতায় থাকাকালীন বিজু জনতা দল (বিজেডি) রাজনৈতিকভাবে জগন্নাথকে ব্যবহার করেছিল, কিন্তু তারা রাজ্যের পরিচয়কে অতিরিক্তভাবে হিন্দুকরণ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আলাদা করে দেখানোর চেষ্টা করেনি। অন্যদিকে, বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগেই জগন্নাথকে এইভাবে ব্যবহার শুরু করে, মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু ভোট একত্রিত করা। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে বিজেপি তখনকার শাসক দল বিজেডির বিরুদ্ধে ‘ওড়িয়া অস্মিতা’ বা ওড়িয়া গর্বে আঘাত করার অভিযোগ তুলে একটি সফল প্রচার চালায়।
পুরীর জগন্নাথ মন্দির ও অ-হিন্দু প্রবেশাধিকার বিতর্ক
একটি ঘটনা বিশেষভাবে বড় বিতর্ক তৈরি করে। একজন বিজেডি নেতার আমন্ত্রণে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার কামিয়া জানি পুরী মন্দিরে প্রবেশ করেন। বিজেপি ও কংগ্রেসের নেতারা অভিযোগ করেন, তিনি গোমাংস খাওয়ার পক্ষে কথা বলেন, তাই তাঁর মন্দিরে প্রবেশ করা উচিত হয়নি। বলা হয়, এতে হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। পুরীর মন্দিরে অ-হিন্দুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধারায় গোমাংস না খাওয়াকে হিন্দু হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন হিসেবে ধরা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এমনকী যেসব হিন্দু প্রকাশ্যে অন্যদের গোমাংস খাওয়ার অধিকারকে সমর্থন করেন, তাঁদেরও মন্দিরে প্রবেশের প্রশ্নে অ-হিন্দুর মতো করেই দেখা হচ্ছে।
২০১৭ সালে বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন মমতা
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি খাদ্যাভ্যাসের স্বাধীনতার পক্ষে, গোমাংসের ক্ষেত্রেও, ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে পুরী মন্দিরে গেলে কিছু মহল তাঁর বিরোধিতা করে। দিঘার মন্দিরে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাও একই কারণে সমালোচিত হচ্ছে। তাঁর সমর্থিত এই মন্দিরে সব ধর্মের মানুষের প্রবেশের সিদ্ধান্তও একই যুক্তিতে সমালোচনার মুখে পড়েছে। বর্তমানে ওড়িশায় একটি রাজনৈতিক প্রবণতা বাড়ছে, যেখানে বাঙালি ও পশ্চিমবঙ্গকে ইসলাম বা মুসলিম পরিচয়ের সঙ্গে এক করে দেখা হচ্ছে। সম্প্রতি ভুবনেশ্বরে মুর্শিদাবাদের পরিযায়ী শ্রমিককে পিটিয়ে খুন, এই সংঘাতে নতুন করে ঘি ঢেলেছে।