ভারতের গুজরাট উপকূলে ৪,০০০ বছরের পুরনো দ্বারকা শহরের নিদর্শন অনুসন্ধানে আবারও সমুদ্রের গভীরে অভিযান শুরু করেছে প্রত্নতত্ত্ববিদদের একটি দল। ভারতের সমুদ্রতীরবর্তী ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং ঐতিহাসিক সত্য উদ্ঘাটনে Archaeological Survey of India (ASI) এর ‘আন্ডারওয়াটার আর্কিওলজি উইং’ দীর্ঘ বিশ বছর পর নতুন করে এই অভিযান পরিচালনা করছে।
দ্বারকার পুরাণ ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
হিন্দু পুরাণ অনুসারে, দ্বারকা ছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাজধানী—একটি সুপরিকল্পিত, সমৃদ্ধ নগরী, যা তাঁর শাসনামলে গড়ে ওঠে। তবে বিশ্বাস করা হয়, শ্রীকৃষ্ণের পৃথিবী ত্যাগের পর দ্বারকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এই ঘটনাটি ‘কালি যুগ’-এর সূচনার প্রতীক বলে বিবেচিত হয়।
এখন, দীর্ঘ বিরতির পর, ASI দ্বারকা ও বেট দ্বারকা (ওখা উপকূলের একটি দ্বীপ) এর নিচে নতুন করে খনন কাজ শুরু করেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করছেন, সমুদ্রতলে হারিয়ে যাওয়া এই শহরটি শুধু পৌরাণিক কাহিনীর অংশ নয়, বরং এটি একটি বাস্তব ঐতিহাসিক নগরী ছিল।
সমুদ্রতলের খনন কাজ: নতুন অভিযান ও নেতৃত্ব
এই অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ASI-এর অতিরিক্ত মহাপরিচালক আলোক ত্রিপাঠি। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, প্রথমবারের মতো বেশ কিছু মহিলা প্রত্নতত্ত্ববিদও এতে অংশ নিচ্ছেন—তাদের মধ্যে রয়েছেন অপারজিতা শর্মা, পূনম বিন্দ এবং রাজকুমারি বারবিন। মূল অনুসন্ধান কাজ পরিচালিত হচ্ছে গোমতি ক্রিক ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে।
১৯৬৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে পরিচালিত গবেষণাগুলোতে দ্বারকার ধ্বংসাবশেষের বিভিন্ন নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল—যেমন প্রাচীন পাত্র, প্রস্তরসীমা, স্তম্ভ (পিলার), এবং জল ব্যবস্থাপনার কাঠামো। এগুলোর গঠন ও পরিকল্পনা দেখে প্রত্নতত্ত্ববিদরা ধারণা করছেন, দ্বারকা ছিল একটি উন্নত নগর ব্যবস্থা সমৃদ্ধ শহর।
দ্বারকার ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
প্রাপ্ত নিদর্শনগুলোর মধ্যে ডুবোজাহাজ ও সমুদ্রতলের স্ক্যানিং প্রযুক্তির মাধ্যমে পাওয়া প্রাচীন নোঙর, বৃহৎ পাথরের ব্লক, খণ্ডিত স্থাপত্যের অংশ এবং জলসঞ্চয় ব্যবস্থার প্রমাণ উল্লেখযোগ্য। এই গবেষণা থেকে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পুরাণ ও ইতিহাসের মধ্যে একধরনের যোগসূত্র থাকতে পারে।
বিশেষ করে, মহাভারত ও বিভিন্ন প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে বর্ণিত দ্বারকার গঠন এবং প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে পাওয়া কাঠামোগুলোর মধ্যে আশ্চর্যজনক মিল লক্ষ্য করা গেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই অভিযান পুরাণ ও ইতিহাসের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
একটি ধর্মীয়, বাণিজ্যিক ও ঐতিহাসিক কেন্দ্র
দ্বারকা শুধু ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, এটি ছিল একসময়কার বাণিজ্যিক কেন্দ্রও। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাচীন কালে দ্বারকা ভারত ও পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে ব্যবসায়িক গেটওয়ে হিসেবে ব্যবহৃত হতো। উদ্ধারকৃত পাত্র, মুদ্রা ও অন্যান্য প্রত্নবস্তু প্রমাণ করে যে, এই নগরী ছিল এক সমৃদ্ধ সভ্যতার প্রতিচিত্র।
ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং দ্বারকা দ্বীপে গিয়ে সমুদ্রতলে ডুব দেন এবং প্রাচীন শহরের ‘দর্শন’ করেন। এটি ভারতের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে দ্বারকার সংযোগকে আরও দৃঢ় করেছে। এখন, ASI-এর গবেষক দল আরও গভীরে অনুসন্ধানে নেমে কৃষ্ণের শহর ‘দ্বারকা’র সত্যিকারের রূপ উন্মোচনে অগ্রসর হচ্ছে। দ্বারকা কি শুধুই পৌরাণিক কাহিনীর অংশ, নাকি এটি বাস্তব ইতিহাসের একটি গৌরবময় নিদর্শন? এই অভিযান হয়তো সেই বহু শতাব্দী ধরে চলে আসা প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হবে।
সমুদ্রের অতল থেকে উঠে আসতে পারে এক হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার কাহিনী, যা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে ভারতের অতীত ও তার ঐতিহ্য।