'এক দিন দেখবে, দেশ এই গানে মেতে উঠেছে। সে দিন আমি থাকব না, কিন্তু তুমি দেখে যেতে পারবে।' কথাটা ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার এক কর্মীকে বলেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তখনও আনন্দমঠ (Anandamath) প্রকাশিত হয়নি। কাগজে গল্প ছাপার প্রুফের নীচে কিছুটা সাদা জায়গা ভরাটের জন্য কর্মীটি 'বন্দে মাতরম'-এর (Vande Mataram) প্রথম দুলাইন ওখানে ছেপে দিতে চাইছিলেন।
প্রথমে ছিল গানটি ছিল 'মল্লার রাগ, কাওয়ালি তাল'
১৮৮২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আনন্দমঠ উপন্যাস রচনা করেন। এই উপন্যাসে বন্দেমাতরম গানটি বারবার ব্যবহার করা হয়। ১৮৯৬ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে বন্দেমাতরম গানটি প্রথম গাওয়া হয়। গানটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই গাওয়া হয়েছিল। ১৮৮২ সালে আনন্দমঠ প্রথম বার বই হয়ে বেরোনোর সময় গানটির নীচে টীকা ছিল, ‘মল্লার রাগ। কাওয়ালি তাল।’ যদুভট্ট সুর দিয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের পছন্দও হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ গানটি সুর দিলেন 'দেশ' রাগে
কিন্তু তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বন্দে মাতরম-এর স্বরলিপি প্রকাশ করলেন ‘দেশ’ রাগে। রবীন্দ্রনাথের সুরেও গানটি বেশ মনে ধরেছিল বঙ্কিমচন্দ্রের। আনন্দমঠের পরের সংস্করণেই লেখা হল, দেশ রাগ। বঙ্কিমের মৃত্যুর পর ১৮৯৬ সালে কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে ওই রাগেই রবীন্দ্রনাথ গানটি গেয়ে শোনান।
প্রথম থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন বঙ্কিম
আসলে বঙ্কিমচন্দ্র 'বন্দে মাতরম' নিয়ে প্রথম থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, গানটি গোটা দেশ গাইবে। রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি সরলা দেবীকে ঘিরেই বলা যেতে পারে 'বন্দে মাতরম' স্লোগানের জন্ম।
সরলাদেবী ও 'বন্দে মাতরম' স্লোগান
স্বদেশি আন্দোলনের সময় ময়মনসিংহের সুহৃদ সমিতি মিছিল করে সরলাকে নিয়ে গেল বক্তৃতামঞ্চে। আওয়াজ উঠল ‘বন্দে মাতরম্’। সর্বভারতীয় স্লোগান হয়ে উঠল বন্দে মাতরম। ব্রিটিশ সরকার ওই স্লোগানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। ব্রিটিশ সরকার রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল, 'বন্দে মাতরম' স্লোগানে ভারতীয়দের একতা দেখে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় বারাণসীতে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সম্মেলনে সরলা দেবী আর লেডি অবলা বসু রয়েছেন। মঞ্চে সরলাদেবী গোটা গানটি গাইলেন। সপ্তকোটির জায়গায় তখনকার ভারতীয় জনসংখ্যা ‘ত্রিংশ কোটি’ গেয়ে দিলেন। হাততালিতে ফেটে পড়ল সভা।
বহু বিপ্লবীর শেষ উচ্চারণ ছিল 'বন্দে মাতরম'
'বন্দে মাতরম' গানটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ঋষি অরবিন্দ ঘোষ। মদনলাল ধিংড়া, প্রফুল্ল চাকি, খুদিরাম বসু, মাস্টারদা সূর্য সেন সহ বহু বিপ্লবী ফাঁসির মঞ্চে শেষ উচ্চারণ করেন, 'বন্দে মাতরম'। ব্রিটিশ পুলিশের হাতে মৃত্যুবরণের সময় মাতঙ্গিনী হাজরাও শেষ স্লোগান দিয়েছিলেন। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী 'বন্দেমাতরম' ধ্বনি দেওয়ার অপরাধে গ্রেফতার হয়েছিলেন। এমনই এই স্লোগানের শক্তি। ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শেই গানের প্রথম দুটি স্তবককে ‘জাতীয় সঙ্গীত’ বলে উল্লেখ করবে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি। সেই নিয়ে বিস্তর বিতর্ক-বিবাদ হয়েছিল। মুসলিম লিগ গানটি গাইতে অস্বীকার করে। পরবর্তীকালে ১৯৫০ সালে ২৪ জানুয়ারি সংবিধানে 'বন্দে মাতরম'-কে ভারতের জাতীয় গান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।