ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অগণিত বিপ্লবী তাঁদের জীবন-যৌবন বলিদান দিয়েছেন। লক্ষ লক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামী মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেসের অহিংস আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তবে, কয়েকজন গিয়েছিলেন ভিন্ন পথে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। শুধুমাত্র গান্ধীজির অহিংসা আন্দোলনের মাধ্যমে যে দেশ স্বাধীন করা যাবে না, একথা বুঝেছিলেন নেতাজি। তবে, ইতিহাস বলছে নেতাজির আগে এটা বুঝেছিলেন আরও এক বাঙালি। তিনি আর কেউ নন, বাংলার বীর সন্তান বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিখ্যাত বিপ্লবী ছিলেন পুলিনবিহারী দাস। তিনি ছিলেন ঢাকা অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। মাতৃভূমির জন্য লড়াই করেছেন সকল বিপ্লবীই। কিন্তু বহুজনের পথ এবং পন্থা ছিল আলাদা। সকলের লড়াই অবশেষে এসে মিলেছে একই বিন্দুতে। আর সেটা হল স্বরাজ। আর ভিন্ন পথে স্বাধীনতার যুদ্ধ লড়েছিলেন বাংলার এই সন্তান। ভারতকে স্বাধীন করতে সর্বপ্রথম আত্মনির্ভরতার পথ দেখিয়েছিলেন বিপ্লবী পুলিনবিহারীই। সশস্ত্র পথেই ভারতের স্বাধীনতা আসবে, তাই গান্ধীজির অহিংস মতাদর্শের সঙ্গে একমত হতে পারেননি তিনি। সে কারণেই তিনি গুরুত্ব দেন শারীরিক, মানসিক ও চারিত্রিক দৃঢ়তা গঠনে। তাই বাংলার তথা পরাধীন ভারতের যুবসমাজকে সশস্ত্র বিপ্লবে পারদর্শী করে তুলেছিলেন।
ঢাকা অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠা করে সেই পথই দেখিয়েছিলেন পুলিন। পুলিনের এই অনুশীলন সমিতি পরবর্তী সময়ে শুধু বাংলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ক্রমে ক্রমে রাজ্যে অনুশীলন সমিতির পাঁচ শতাধিক শাখাও স্থাপিত হয়। কাশী, দিল্লি, লাহোরেও বিপ্লব কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর ঢাকাতেই প্রতিষ্ঠা হয় ‘ন্যাশনাল স্কুল’। আদতে ওটি ছিল সশস্ত্র বিপ্লবী দল তৈরির একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। পুলিনবাবু যে কোনও আগ্নেয়ান্ত্র চালানোতে পটু ছিলেন। সেই মতোই অনুশীলন সমিতির সভ্যদের গড়ে তোলেন। সমিতির প্রত্যেক কর্মীর কাছে পিস্তল থাকত। কেবল অস্ত্র চালানো নয়, দেশীয় অস্ত্র যেমন লাঠি, ছুরি, অসি ও যুযুত্সুর প্যাঁচে তাঁকে এশীয় মহাদেশের পুরোধা বলে ধরা হয়। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি সেই সময়ে বসে নানাবিধ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে রীতিমত গবেষণা করছিলেন এবং লিখে ফেলেছিলেন একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘লাঠিখেলা ও অসিশিক্ষা’৷ শোনা যায়, ঢাকা কলেজের রসায়নে গারে প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সহায়তায় গোপনে তিনি বোমা বানানো শেখেন। জানা যায়, বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর বোমা নিক্ষেপ করার ২ বছর আগেই পুলিনবিহারী বোমা বানিয়ে ফেলেন ও তার ব্যবহারও করেছিলেন। বোমা বানাতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
ক্রমেই তিনি ব্রিটিশের ত্রাস হয়ে ওঠেন। পরে তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। ১৯১০ সালে ছাড়া পেয়ে আবারও বিপ্লবী কাজ শুরু করেন তিনি। ওই বছরের জুলাই মাসে ঢাকা যড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দিয়ে আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠানো হয়। তবে, ১৯১৯ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে যান। মুক্তি পাওয়ার পর সমিতির কাজে আত্মনিয়োগ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তখন তাঁর সেই সংগঠনকে সরকার নিষিদ্ধ করার ফলে সদস্যরা এখানে ওখানে ছড়িয়ে পড়েন। বহু বিপ্লবী গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু পুলিনবিহারী দাস কখনও গান্ধীর আদর্শের সঙ্গে আপোস করতে চাননি এবং তাঁকে নেতা বলেও মানতে পারেননি। ১৯২০ সালে তিনি তৈরি করেছিলেন 'ভারত সেবা সংঘ'। পরে তিনি এই সংঘ ভেঙে দেন। পরবর্তীকালে ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন 'বঙ্গীয় ব্যায়াম সমিতি'। যা পরিচিত ছিল পুলিন দাসের আখড়া নামে। এই আখড়ায় তরুণদের লাঠি, তরোয়াল চালানো ও কুস্তি শেখানো হত।
পুলিনবাবুর কর্ম ও ভাবধারায় আকৃষ্ট হয়েছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুও। বিলেতে থাকার সময়েই তাঁর কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে পারেন নেতাজি। ১৯৩০ সালে নেতাজি ও পুলিনবিহারীর সাক্ষাৎ হয়। নেতাজি তাঁর বাড়িতেও যেতেন। সেই ভাবেই তিনিও বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত হন। কলকাতা পুরসভায় মেয়র থাকাকালীন বঙ্গীয় ব্যায়াম সমিতিকে ২০ কাঠা জমি দান করেন নেতাজি। পুলিনবিহারীর পরিবারের দাবি, নেতাজি ছিলেন পুলিনবিহারীর মন্ত্রশিষ্য। স্বাধীনতার ৭৬ বছর পূর্তিতে দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে। তবে, সেই বৃত্তের বাইরে বিস্মৃতই রয়ে গেছে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর বলিদান। তাঁদের মধ্যে এই বাঙালি বিপ্লবীও রয়েছেন। এই বিষয়ে কী মনে করছেন পুলিনবিহানী দাসের দুই নাতি বিশ্বরঞ্জন দাস ও মণীশরঞ্জন দাস। তাঁদের মুখেই শুনে নেব।
বিশ্বরঞ্জন দাস বলেন, 'পুলিনবিহারী দাসকে বাঙালি ভুলে যায়নি। তবে সমস্যা হল সরকার মনে রাখেনি। শিক্ষা দফতর মনে রাখেনি। সিলেবাসে অনুশীলন সমিতির সম্পর্কে তেমন কিছু বলা নেই। যারা পাঠ্যক্রম তৈরি করছেন তাঁরা বলতে পারবেন। ছোট ক্লাস থেকে এই বিষয়ে পড়ানো উচিত। আমরা চাই সবটাই স্কুলে পড়ানো হোক। মার্শাল আর্ট নিয়ে গবেষণা হোক।'
মণীশরঞ্জন দাসের আবার একটু ভিন্ন মত। তিনি জানান, পুলিনবিহারী দাসকে বাংলা মনে রেখেছে। যাদের মনে রাখার তাঁরা মনে রেখেছেন। তাঁর জন্মদিন ভারতের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক ভাবে পালন করা হয়। তবে সেলুলার জেলে আজও পুলিনবিহারী দাসের আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠা বসেনি। সরকারি তরফে একবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।'