Advertisement

Hemanta Mukhopadhyay: 'জুনিয়র পঙ্কজ' থেকে গানের জগতে ঋতু হয়ে উঠেছিলেন হেমন্ত

দক্ষিণ কলকাতার একটা অনুষ্ঠানে পঙ্কজ মল্লিক আর হেমন্ত দু’জনেই উপস্থিত ছিলেন। সেখানে দর্শকরা হেমন্তকে ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি গাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু হেমন্ত  দর্শকের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছিলেন ‘পঙ্কজদার সামনে ওই গান গাইতে পারব না। আমাকে মাফ করবেন।’ তবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তিমযাত্রায় এক নম্বর গার্স্টিন প্লেসের  আকাশবাণীর পুরনো বিল্ডিংয়ে সরাসরি সম্প্রচারে হেমন্ত গেয়েছিলেন, “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন”। কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন বাঙালিকে। এমন দরদী রবীন্দ্র সংগীত হয়তো বাঙালি প্রথম শুনল। আর তখন থেকেই হেমন্ত যুগের সূচনা।

কিশোর কুমারের সঙ্গে গানের রেকর্ডিংয়ে।
রজত কর্মকার
  • কলকাতা,
  • 16 Jun 2021,
  • अपडेटेड 12:29 PM IST
  • কলার তোলা কাকে বলে তা তিনি দেখিয়েছিলেন ১৯৭০ সালে। চিরকাল বাম মনোভাবাপন্ন হেমন্ত পদ্মশ্রী সম্মান নিতে অস্বীকার করেন।
  • সারা জীবনে অসংখ্য সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৮৫ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি. লিট সম্মান প্রদান করে।
  • সিগারেট খাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সহাস্যে বলতেন, 'সিগারেট না খেলে গলার গ্রেনটা ভাল আসে না। গলা পরিষ্কার হয় না।'

বাংলা ছবির গানের জগতে এক অবিস্মরণীয় নাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (Hemanta Mukhopadhyay) । তিনি ছিলেন একাধারে গায়ক, সুরকার ও প্রযোজক। তাঁর ব্যারিটোন কণ্ঠে গানের জগতে সারা দেশ এক নতুন ঋতুর সন্ধান পেয়েছিল। বড় অদ্ভূত বিষয়, কোনও দিন গানের প্রথাগত তালিম নেননি! অথচ তাঁর সঙ্গীতে রাগ-রাগিনীর ব্যবহার ছিল অবাক করার।

১৬ জুন বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেন হেমন্ত। বারাণসীতে ছিল তাঁরা মামাবাড়ি। হেমন্ত’র আদি বাড়ি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ‘বহরু’ গ্রামে। ১৯০০ সালের শুরুর দিকে বাবা কালিদাস মুখোপাধ্যায় তাঁর পরিবার নিয়ে কলকাতার ভবানীপুরে বসবাস শুরু করেন। ভবানীপুরের নাসিরুদ্দিন স্কুল এবং মিত্র ইন্সস্টিটিউশন থেকে প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনা সম্পূর্ন করেন। বাবার ইচ্ছায় তিনি যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। তার কারণও ছিল অবশ্য। পড়াশোনার তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তবে গানের প্রতি তীব্র আকর্ষণ তাঁকে গানের দিকে টেনে নিয়ে আসে। আর গানের কারণেই হেমন্ত’র আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া সম্পূর্ণ করা হয়নি।

স্কুলে পড়ার সময় টিফিনের সময় তিনি বন্ধুদের গান গেয়ে শোনাতেন। মিত্র ইন্সস্টিটিউশনে পড়ার সময় তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় বিখ্যাত সাহিত্যিক ও কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের। স্কুলে সর্বক্ষণ গান গাওয়ার কারণে একবার পরীক্ষার আগে স্কুল থেকে তাঁর নাম কেটে দেওয়া হয়েছিল। বাবা কালিদাস মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে তাঁকে আবার স্কুলের পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেওয়া হয়।

বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় হেমন্ত’র গানের জগতে প্রবেশ ঘটে। সুভাষ রেডিয়োর তবলা বাদক অসিতবরণের সাহায্যে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে হেমন্তর অডিশনের ব্যবস্থা করেন। অডিশন দেওয়ার প্রায় তিন মাস বাদে হেমন্ত রেডিওতে অনুষ্ঠান করার ডাক পান। ১৯৩৫ সালে হেমন্ত অল ইন্ডিয়া রেডিওতে জীবনের প্রথম গান রেকর্ড করেন। গানটি ছিল “আমার গানেতে এলে নবারূপী চিরন্তনী”।

Advertisement
গানের রেকর্ডিংয়ে লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং অভিনেতা বিশ্বজিৎ

পঙ্কজ কুমার মল্লিক তাঁর ভীষণ পছন্দের। তাঁকে অনুসরণ করেই গান গাওয়া শুরু। ‘ছোটো পঙ্কজ’ বলা হতো তাঁকে। আত্মজীবনী ‘আনন্দধারায়’ পঙ্কজ কুমার মল্লিকের প্রতি তাঁর সম্ভ্রম বোঝাতে হেমন্ত লিখছেন- “আমি তখন পঙ্কজদার ঢঙে গান গাইছি। আমাকে দেখে অনেকে বলে জুনিয়ার পঙ্কজ। খুব বাহবা দেয়। তখনও আমার সঙ্গে পঙ্কজদার আলাপ পরিচয় নেই। খুব ইচ্ছে হলো একদিন আলাপ করবার। ...একদিন সাহসে ভর করে গেলাম ওঁর সেবক বৈদ্য স্ট্রীটের বাড়িতে। বাড়িতে পেলাম ওঁকে। খুব সঙ্কোচের সঙ্গে নিজের পরিচয় দিলাম। উনি শুনে বললেন, ‘ও, তুমিই হেমন্ত? বাঃ বেশ। বেশ ভাল গান করো। আচ্ছা আচ্ছা।’ ... ওই কটা কথা বলে উনি বেরিয়ে গেলেন। গাড়ি ছাড়বার আগে মুখ বাড়িয়ে আমাকে বললেন ‘আমি নিউ থিয়েটার্স যাচ্ছি, তুমি কোথায় যাবে? আমি বললাম আমি ভবানীপুরে। উনিই একাই চলে গেলেন টালিগঞ্জের দিকে।’”

ওই সময় থেকেই রবীন্দ্র সঙ্গীতের তরুণ অনুরাগীরা পঙ্কজ আর হেমন্ত দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেছেন এ কথা অনেকেই বলতেন। হেমন্ত অবশ্য এ কথা স্বীকার করতেন না। দক্ষিণ কলকাতার একটা অনুষ্ঠানে পঙ্কজ মল্লিক আর হেমন্ত দু’জনেই উপস্থিত ছিলেন। সেখানে দর্শকরা হেমন্তকে ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি গাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু হেমন্ত  দর্শকের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছিলেন ‘পঙ্কজদার সামনে ওই গান গাইতে পারব না। আমাকে মাফ করবেন।’ তবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তিমযাত্রায় এক নম্বর গার্স্টিন প্লেসের  আকাশবাণীর পুরনো বিল্ডিংয়ে সরাসরি সম্প্রচারে হেমন্ত গেয়েছিলেন, “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন”। কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন বাঙালিকে। এমন দরদী রবীন্দ্র সংগীত হয়তো বাঙালি প্রথম শুনল। আর তখন থেকেই হেমন্ত যুগের সূচনা।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে হেমন্ত কুমার হওয়ার যাত্রা শুরু হয় পঞ্চাশের গোড়ায়। প্রথম সুর দেন হিন্দিতে ‘আনন্দ মঠ’ (১৯৫৩) ছবিতে। তাঁর সুরে লতা মঙ্গেশকরের গলায় ‘বন্দে মাতরম’ গানটি অন্য মাত্রা পেয়েছিল। এরপর, ‘ডাকু কি লেডকি’, ‘নাগিন’, ‘সম্রাট’, ‘বন্দিশ’, ‘আনজান’ একের পর এক ছবিতে তাঁর সুরে হিট গান। ১৯৫৬ সালে ‘নাগিন’ সিনেমার জন্য সেরা সুরকার হিসাবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জেতেন। গুলজার তাঁর স্মৃতি কথায় বলছেন, 'বলিউডে একধারে গান গাইছেন, সুর করছেন, সিনেমা প্রোডিউস করছেন, ষাটের দশকে এমন কলার তোলা বাঙালি দেখা যেত না।'

কলার তোলা কাকে বলে তা তিনি দেখিয়েছিলেন ১৯৭০ সালে। চিরকাল বাম মনোভাবাপন্ন হেমন্ত পদ্মশ্রী সম্মান নিতে অস্বীকার করেন। সারা জীবনে অসংখ্য সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৮৫ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি. লিট সম্মান প্রদান করে।

স্ত্রী এবং নাতনীর সঙ্গে

মার্সিডিজ চালিয়ে বম্বে শহরে ঘুরে বেড়াতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হাতে সিগারেট, কখনও নস্যি। যাঁর এমন ব্যারিটোন গলা, তাঁর ঠোঁটে প্রায় সব সময় সিগারেট জ্বলত! সিগারেট খাওয়া নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সহাস্যে বলতেন, 'সিগারেট না খেলে গলার গ্রেনটা ভাল আসে না। গলা পরিষ্কার হয় না।' আজকের দিনেও এমন কথা বলার সাহস কোনও গায়ক দেখাতে পারবেন কিনা জানা নেই। সিগারেট প্রসঙ্গে শিল্পী আরতি মুখোপাধ্যায় একটি অদ্ভূত কাহিনি শুনিয়েছিলেন।

হেমন্ত-আরতির ডুয়েট গান রেকরডিং হচ্ছে স্টুডিওতে । যথারীতি স্টুডিওর মধ্যেও হেমন্ত-র ঠোঁটে জ্বলছে সিগারেট। এই ছাড় কেবলমাত্র তাঁর ক্ষেত্রেই ছিল। তাই স্টুডিওর মধ্যে রাখা থাকত একটি অ্যাস্ট্রে । হেমন্ত আরতিকে বললেন, ‘নে শুরু কর’। আরতি জানালেন, ‘সিগারেটটা নেভান’। ‘আরে সিগারেটের সঙ্গে গানের কি আছে?’ আরতি তো রীতিমতো অবাক! যাই হোক রেকর্ডিং শুরু হল, আরতি গাইতে শুরু করলেন। 

Advertisement

আরতি নিজের অংশটুকু যখন গাইছেন তখন হেমন্ত সিগারেটে সুখটান দিচ্ছেন আর ধোঁয়া ছাড়ছেন। কিন্তু যখনই হেমন্তর গাওয়ার পালা ঠিক তার আগের মুহূর্তে তিনি সিগারেটটি অ্যাশ ট্রে-র ওপর রেখে আনায়াসে গেয়ে দিচ্ছেন। ফের সিগারেটটি তুলে সুখটান। অন্যদিকে পাশের শিল্পী তাঁর সহ শিল্পীকে দেখে শিউরে উঠছেন। কিন্তু হেমন্ত তার নিজের অংশটুকু অবলীলায় শেষ করে সিগারেটে টান আর ধোয়া ছাড়া। শিউরে উঠলেও আরতিও গাইলেন নিখুঁত। এইভাবে রেকর্ডিং শেষ হতেই আরতি বলে উঠলেন, কী আশ্চর্য! হেমন্ত বললেন, ‘কী করব ওটা যে আমায় কিছুতেই ছাড়তে চায় না’।

১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অবশ্য চিরকালের মতো ছেড়ে গিয়েছিল তাঁর প্রিয় সিগারেট এবং বাঙালির প্রিয় গায়ক। ১৯৮০ সালে প্রথমবার হার্ট অ্যাটাক হয়। তার পর থেকেই অসুস্থ থাকতেন। তবে দ্বিতীয় বারের ধাক্কা আর সামলে উঠতে পারেননি। চলে গিয়েছেন চিরবসন্তের দেশে।

 

Read more!
Advertisement

RECOMMENDED

Advertisement