১৯৯০-এর শুরুর দিকের কথা। অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী (Sabyasachi Chakraborty) সত্যজিৎ রায়ের (Satyajit Ray) সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তাঁর বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে। উদ্দেশ্য ছিল ফেলুদার (Feluda) চরিত্রে অভিনয় করতে চান বেণু দা। সে কথাই বলতে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়কে। বেশ কিছু ক্ষণ সব্যসাচীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন বিশ্ববরেণ্য চিত্র নির্মাতা। তার পর বলেন, 'সন্তোষ (Santosh Dutta) ছাড়া জটায়ু আর কেউ করতে পারবে না।' তার বছর দুয়েক আগেই পরলোকে চলে গিয়েছেন পর্দার জটায়ু।
সংক্ষিপ্ত উত্তরেই স্পষ্ট সন্তোষ দত্ত কোন জাতের অভিনেতা ছিলেন এবং কেন সত্যজিৎ রায় আর ফেলুদা নিয়ে ছবি করার কথা ভাবেননি। ২ ডিসেম্বর ১৯২৫ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন সন্তোষ দত্ত। ছোট থেকে অভিনয় এবং নাটকের প্রতি অসম্ভব টান ছিল। সেই টান কাটাতেই অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে তাঁকে ঘোর সংসারমুখী করতে চেয়েছিলেন তাঁর বাবা। যদিও থিয়েটারের নেশা বাবার কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন সন্তোষ। আর নাটক এবং অভিনয়ের প্রতি সেই টানই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল সিনেমার পর্দায়। তা-ও সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে পরশপাথর ছবিতে।
রূপকার গ্রুপের হয়ে তিনি চলচ্চিত্তচঞ্চরী নাটকে ভবদুলালের চরিত্রে অভিনয় করছিলেন সন্তোষ। দর্শকাসনে বসেছিলেন সত্যজিৎ। জহুরির চোখ, তাই রত্ন চিনতে সময় লাগেনি, ভুলও হয়নি। বুঝে গিয়েছিলেন, সন্তোষ দত্তর অভিনয় দক্ষতা ভারতীয় সিনেমাকে সমৃদ্ধ করবে। তেমনটাই আখেরে হয়েছিল। পরশপাথর থেকে শুরু। তার পর একে একে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গেই আটটি ছবিতে নানা চরিত্রে অভিনয় করেন সন্তোষ। যার মধ্যে গুগাবাবা এবং হীরক রাজার দেশে ছবিতে ডাবল রোলে অভিনয় করেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের (Soumitra Chatterjee) বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা দেখে তিনি যেমন ফেলুদার চরিত্র কল্পনা থেকে বাস্তবে নামিয়ে আনেন, তেমনই সন্তোষ দত্তকে দেখার পর জটায়ু চরিত্রের অবতারণা।
সোনা কেল্লা ছবিতে প্রথম এই চরিত্রের সঙ্গে আলাপা হয় বাঙালির। সুটকেস, হোল্ডল, জলের ফ্লাস্ক, হ্যান্ড ইত্যাদি কুলির মাথায় কাঁধে চাপিয়ে কামরার দরজা আটকে প্রবেশ ঘটে জটায়ুর। প্রথম সংলাপ বাঙালি অ্যাক্সেন্টে হিন্দি বলিয়ে করেছেন সত্যজিৎ, 'সামহালকে ইমপোর্টেড হ্যায় জাপানি সুটকেস।' তার পরই 'তাং মাত কারো তাং মাত কারো... কাফি হো গিয়া, জাদা হো গিয়া... যাও, যাওঃ...' বলে কুলিতে বিদায় করা।
ফার্স্ট ইমপ্রেশন একেবারে হৃদয়ে ছেপে বসে গিয়েছিল। সেই ছাপ আর কোনও অভিনেতা ফিকে করতে পারেননি। রবি ঘোষ (Rabi Ghosh), অনুপ কুমারের (Anup Kumar) মতো অসাধারণ শিল্পীরাও পারেননি। তবে শুধুমাত্র জটায়ু বা হাল্লা-সুন্ডির রাজা, বৈজ্ঞানিক নয়, বাংলা ছবিতে বেশ কিছু স্মরণীয় চরিত্রে অভিনয়ের ছাপ রেখে গিয়েছেন সন্তোষ।
প্রথম জীবনে ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কে (যার আজকের নাম স্টেট ব্যাঙ্ক অফি ইন্ডিয়া) চাকরি করতেন সন্তোষ। তবে তাঁকে ওডিশায় বদলি করে দেওয়ায় চাকরি ছেড়ে ওকালতি শুরু করেন। তার আগেই অবশ্য ওকালতি পাশ করে ফেলেছেন। এই ওকালতির জন্য সোনার কেল্লা ফসকে যাচ্ছিল তাঁর হাত থেকে। দীর্ঘ ওকালতি জীবনে তাঁর একমাত্র জুনিয়র এবং সহকর্মী ছিলেন অশোক বক্সী। অশোকবাবু তাঁর স্মৃতিচারণায় লেখেন,
'আর একটু হলেই ‘সোনার কেল্লা’ থেকে ছিটকে যাচ্ছিলেন জটায়ু সন্তোষ দত্ত! একটা হত্যাকাণ্ডের মামলা নিয়ে সন্তোষ দত্তের তখন দিন রাত এক হয়ে গেছে। তার মাঝেই একদিন ফোন এল বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়ি থেকে। ফোন রেখে গম্ভীর মুখে সন্তোষদা বললেন, “এ তো মহা মুশকিলে পড়লাম দেখছি। মানিকদা ফোন করেছিলেন। আমাকে জটায়ু করার জন্য বললেন। রাজস্থানে এক মাসের শ্যুটিং। যেদিন যাবার কথা সেদিনই মামলার শুনানি। কী করি বলো তো?” তখনকার সময়ে আদালতে দিন পড়লে মুলতুবি নেওয়া অত সহজ ছিল না। সন্তোষদা সোজাসুজি ফোন করলেন মামলায় বিরোধী পক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটরকে। সব খুলে বললেন। চেয়ারের উল্টো দিকে বসে অশোকবাবু শুনতে পাচ্ছেন, ওপার থেকে উত্তর ভেসে আসছে, “অত ঘাবড়াবার কী আছে? শুনানি যাতে না হয় তার সব বন্দোবস্ত আমি করব। তুমি শুধু একটা পিটিশান করে নিয়ে এসো।” জজ সাহেব ছিলেন শচীন সান্যাল। পিটিশান নিয়ে ওঁর ঘরে অশোকবাবুরা তিনজনে হাজির। জজকে সত্যি কথাটাই বললেন সেই পাবলিক প্রসিকিউটর। সঙ্গে এও বললেন, “মামলাটা যদি এক মাস পিছিয়ে যায়, আমার কোনও আপত্তি নেই।” শচীন সান্যাল সব শুনে বললেন, “ঠিক আছে, আপনি ওঁর বিরোধী হয়েও যখন এ কথা বলছেন, আমি অ্যালাও করে দিচ্ছি।” এ ভাবেই ‘জটায়ু’র ছাড়পত্র পেয়েছিলেন সন্তোষদা।'
শুধু সোনা কেল্লা নয়, জয়বাবা ফেলুনাথ-এও শেষবারের মতো জটায়ুর চরিত্রে অভিনয় করেন সন্তোষ। মগনলাল মেঘরাজের ডেরায় তাঁর কী অবস্থা হয়েছিল তা দর্শক মাত্রেই জানবেন। সে দিনের শুটিংয়ে কী হয়েছিল, সেটা পরে ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর সংখ্যার ‘সন্দেশ’ পত্রিকার ‘ফেলুদা ৩০’ নামে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যায় লিখেছিলেন সন্দীপ রায় (Sandip Ray)। তাঁর ভাষায়,
'১৬ মে, ১৯৭৮। ইন্দ্রপুরী স্টুডিও। জয় বাবা ফেলুনাথ সিনেমার সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যের শুটিং। স্টুডিওর একটা ফ্লোরে তৈরি করা হয়েছে মগনলালের বৈঠকখানা। অর্জুনের ছুরি যেখানে গিয়ে বিঁধবে একটার পর একটা, সেটা কাঠের তৈরি, বাবা সেখানে একটা রাক্ষসের ছবি আউটলাইন করে দিয়েছেন। সেটা শিল্পীরা তার উপরে রং করছেন- সব মিলিয়ে জমজমাট একটা ব্যাপার। শুরু হল দৃশ্যগ্রহণ। প্রথমে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে ছুরি ছোঁড়ার দৃশ্যটা তোলা হল। বেশ কয়েকটা শটে জটায়ু ও আছেন, তবে সেগুলো ছুরি ছোঁড়ার ঠিক আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। আর যে শটগুলোতে অর্জুন (কামু মুখোপাধ্যায়) ছুরি ছুঁড়ে দিচ্ছেন সেখানে বলাবাহুল্য উল্টোদিকে জটায়ু নেই। এবার সেই শট- যেখানে দেখানো হচ্ছে সন্তোষদার শরীরের চারপাশে এসে ছুরিগুলো বিঁধছে। সেই কাঠের বোর্ডের সামনে সন্তোষদাকে এনে দাঁড় করানো হল।'
'কিন্তু আশ্চর্য- একটা ছুরিও তার দিকে লক্ষ করে ছোঁড়া হল না! উল্টোটা করা হল। সন্তোষদার শরীর থেকে এক বা দেড় ইঞ্চি দূরে ছুরিগুলোকে বোর্ডের গায়ে পরপর গেঁথে দেয়া হল। প্রতিটা ছুরির পেছনে বাঁধা চিকন নাইলনের তার, যা ক্যামেরায় ধরা পড়বে না। ক্যামেরার চোখের বাইরে থেকে সেই তারগুলোকে টানটান করে ধরেছিলাম আমি আর কয়েকজন। এবার ক্যামেরা চালু হল কিন্তু উল্টো গতিতে- ইংরেজিতে যাকে বলে রিভার্স মোশন ফটোগ্রাফি। আমরা এক একটা নাইলনের দড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান দিচ্ছি আর একটা করে ছুরি বোর্ড থেকে খুলে বেরিয়ে আসছে আর সেটাকে তুলে নিচ্ছে ক্যামেরা, উল্টো গতিতে। যার অর্থ, এই ছবি যখন প্রোজেক্টরে সাধারণ গতিতে চলবে, তখন দেখা যাবে একটার পর একটা ছুরি বিদ্যুৎগতিতে সন্তোষদার চারপাশে গেঁথে যাচ্ছে!'
'বাবার এই দুর্দান্ত পরিকল্পনা পর্দায় কি চেহারা নিয়েছিল সেটা আশা করি আর নতুন করে বলার কোন দরকার নেই। রিভার্স মোশনে সিনেমার ছবি তুললে সেটা দেখার সময় অভিনেতার অভিব্যক্তিও উল্টো হয়ে যায় অর্থাৎ কেউ গম্ভীর মুখ থেকে হেসে ফেললে সেটাকে পর্দায় দেখা যাবে হাসি থেকে গম্ভীর মুখে পরিবর্তিত হতে। বাবা সন্তোষদাকে বলে দিয়েছিলেন- প্রতিবার ছুরি খুলে বেরিয়ে আসার সময় উল্টো রিঅ্যাকশন দিতে। এটা প্রচণ্ড কঠিন একটা কাজ। কিন্তু ঠিক কতটা নিখুঁতভাবে সন্তোষদা কাজটা করেছিলেন- সেটা তো দৃশ্যটা দেখলেই বোঝা যায়।'
সন্তোষ দত্তকে যারাই দেখেছিলেন তাঁদের প্রায়ই একটা কথা মনে হত, তাঁর দুটো সত্তা – একটা মঞ্চের বা পর্দার। যেখানে তাঁকে মনে হত, আলুথালু একজন মানুষ। সেই মানুষই আবার যখন বাস্তব জীবনে ঢুকতেন, ছবিটা পুরো বদলে যেত! বাড়ি বলতে অজ্ঞান। পরিবারের একমাত্র ছেলে ছিলেন। চার বোন ছিল তাঁর। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বালবিধবা। সবাই দেশের বাড়ি থাকতেন। তাঁদের যে কত রকমের দায়িত্ব বয়ে বেড়িয়েছেন সারাজীবন!
আর তাঁর মধ্যে মাতৃভক্তি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা সকলেই জানিয়েছেন, খুব কম জনের মধ্যেই অতটা দেখা যায়। ‘কোয়েলের কাছে’ ছবির শ্যুটিং হচ্ছে। তখনকার মাদ্রাজে। খবর গেল সন্তোষ দত্তের মা আর নেই। তখনই তিনি ফিরে এলেন কলকাতায়। সে বারের মতো সন্তোষ দত্তকে অত ভেঙে পড়তে খুব কম দেখা গিয়েছিল।
এছাড়াও তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। পড়তে পড়তেই দুর্দান্ত ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন হলিউডের বিখ্যাত কমেডিয়ান গ্রাউচো মাক্সের। আর হাতের লেখা? পরিচিতজনেদের মন্তব্যে, মুক্তাক্ষর বললেও কম বলা হয়। যেমন বাংলা, তেমন ইংরেজি। বিভিন্ন কায়দার হরফেও লিখতে পারতেন। ক্যালিগ্রাফিও।
প্রায় সকল মানুষের মতো স্বীকৃতি এবং সম্মানের খিদে ছিল তাঁর মধ্যে। কিন্তু তাঁর মতো অভিনেতা সেটা পাননি। সেই অভিমান, একটা চাপা কষ্ট চিরকা বুকে নিয়ে থাকতেন সন্তোষ। সেই চাপ থেকেই হয়তো বুকে ক্যানসারের হানা। ফুসফুসে ক্যানসার। ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে রে নিচ্ছেন, আবার কাজও করছেন। অসম্ভব পরিশ্রমী ছিলেন ব্যক্তিজীবনে। সত্যজিৎ রায় ঠিকই বলতেন, তুলসি চক্রবর্তী, উৎপল দত্ত, রবি ঘোষ, সন্তোষ দত্ত-র মতো অভিনেতারা বিদেশে জন্মালে একাধিক অস্কার পেতে পারতেন। সেই অভিমান নিয়েই ৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮ চিরতরে চলে গেলেন সন্তোষ দত্ত।
হয়তো সেই জায়গা থেকেই সত্যজিৎ রায় আর কোনও দিন ফেলুদা নিয়ে ছবি না করে এক রকমের সম্মান জানিয়ে গেলেন। সত্যজিতের জটায়ু মানে একজনই, সন্তোষ দত্ত। 'সন্তোষ ছাড়া জটায়ু আর কেউ করতে পারবে না।' সত্যজিৎ রায়ের অমোঘ উক্তি অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছিল। অন্তত জীবিত অবস্থায় এই উক্তি কেউ টলাতে পারেননি।
কৃতজ্ঞতা:
আনন্দবাজার পত্রিকা
জটায়ুকে যেমন দেখেছি, রুপালি প্রকাশনা
ইন্টারনেট