হরীন্দ্রনাথ বললেন অনেকে প্রতিবাদ করেন। অনেকে হয়তো চিনতেও পারেন না। কারণ তিনি হারিন চ্যাটার্জি নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর নামের প্রকৃত উচ্চারণ হরীন্দ্রনাথ। তবে নামে কী যায় আসে! যে নামেই তাঁকে ডাকা হোক না কেন, তিনি দুটি চরিত্রের জন্য বিশেষত বাঙালির হৃদয়ে চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছেন। প্রথমটি গুগাবাবা-র জাদুকর বরফি। দ্বিতীয়টি সোনার কেল্লার সিধু জ্যাঠা। সত্যজিৎ রায় হয়তো বুঝেছিলেন, বইয়ের পাতা থেকে সিধু জ্যাঠাকে যদি বড় পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে হয় তা হলে বাস্তবের সিধু জ্যাঠাকে প্রয়োজন। সে কারণেই সম্ভবত ওই ছোট্ট চরিত্রের জন্য হরীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বেছে নিয়েছিলেন।
কেন তিনি বাস্তবের সিধু জ্যাঠা সেটা এ বার জেনে নিন। তিনি একাধারে কবি, গায়ক, অভিনেতা, গীতিকার, আবৃত্তিকার, প্রযোজক, রাজনীতিবিদ, কেমব্রিজের স্কলার, স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং সাংসদ। তাঁর দিদি ছিলেন সরোজিনী নাইডু জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি। দাদা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বামপন্থী ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে হরীন্দ্র একই মতাদর্শে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি ভারতের কমিউনিস্টদের আন্দোলনে সমর্থন আদায়ের জন্য ১৯২০ সালেই মস্কো চলে যান৷ পরে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার হয়েছিলেন৷ স্তালিনের শুকিরণের কোপে পড়ে জেলে যান৷ রাশিয়াতেই, মস্কোতে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল৷ এই দাদাই নিশ্চিতভাবে হরীন্দ্রনাথকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন বামপন্থী মতবাদে বিশ্বাসী হতে৷
মাত্র ২০ বছর বয়সে বাল্য বিধবা কৃষ্ণা রাওকে বিয়ে করেন হরীন্দ্র। তবে লোকে তাঁকে কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় নামেই চেনেন। যিনি নিজের কীর্তিতেই সারা বিশ্বে পরিচিত পেয়েছিলেন। সাংবাদিকতায় পেয়েছিলেন র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার। পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ পুরস্কারকে তাঁকে ভূষিত করা হয়েছে। হরীন্দ্রনাথ নিজেই উদ্যোগী হয়েছিলেন কমলাদেবীর ব্যাপারে৷ বিয়ের পর নিজে বিলেত গিয়ে মাস কয়েক পরেই কমলাদেবীকে নিয়ে গিয়ে ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের বেডফোর্ড কলেজে ভর্তি করে দেন৷ সে সময় দেশ পরাধীন। তখন নারী শিক্ষা নিয়ে তিনি যে সমস্ত কাজ করেছিলেন যা আজকের দিনেও খুব কম মানুষ ভেবে উঠতে পারেন। অবশ্য এ সব তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন বাবা এবং মায়ের কাছ থেকে। তাঁরাও নারী শিক্ষায় বিশেষ ভাবে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা রীতি রয়েছে। ডক্টরেট না হলে সেখানে রিসার্চ করার অনুমতি দেওয়া হয় না। হরীন্দ্র-র ক্ষেত্রে সেই নিয়ম খাটেনি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'দি ফিস্ট অফ ইউথ' এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে উচ্চতর গবেষণার জন্য স্বাদরে গ্রহণ করেছিলেন। আর হবে নাই বা কেন, তাঁর কবিতার প্রশংসক ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দশ বছর বয়সে শহিদ ক্ষুদিরাম বসুকে নিয়ে কবিতা 'ডাইং পেট্রিয়ট' কবিতা লেখেন। যার ফলে তৎকালীন সময়ে রাজরোষে পড়ার জোগাড় হয়েছিল শিশু হরীন্দ্র-র। মাত্র ১১ বছর বয়সে তাঁর লেখা নাটক আবুল হাসান মঞ্চস্থ হয়। সেই টাকা তিনি দান করেন অ্যানি বেসান্তের ন্যাশনাল এডুকেশন ফান্ডে। গান্ধীজি যখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে দিয়েছিলেন, সে সময় তিনি হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় গান লিখেছেন, সুর করেছেন এবং গেয়েছেন। 'শুরু হুই জং হামারি' গানের জন্যে ৬ মাস জেল খাটতে হয়েছে হরীন্দ্রকে।
দেশ বিদেশের বহু পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। দি কফিন, এনসিয়েন্ট উইং, ডার্ক ওয়েল, দি ডিভাইন ভ্যাগাবন্ড, ব্লাড অফ স্টোনস, স্প্রিং ইন উইন্টার, দি উইজার্ড মাস্ক, ফাইভ প্লেজ-এর মতো অজস্র রচনা রয়েছে ইংরেজি ভাষায়। বিখ্যাত 'ইন্টারন্যাশনাল' সংগীতের হিন্দি তর্জমা করেছেন তিনি। হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্য বহু গান রচনা করেছেন তিনি। যার মধ্যে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য জুলি সিনেমার, মাই হার্ট ইজ বিটিং, কিপস অন রিপিটিং...। নিজেও সংগীতশিল্পী হিসেবে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৪৪ সালে গণনাট্য সংঘের কর্মীরা কলকাতায় একটি অনুষ্ঠান করে, যেখানে তিনি এককভাবে গান, হারমোনিয়াম বাদন, কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন।
১৯৫২ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত লোকসভার সদস্য ছিলেন হরীন্দ্র। অসম্ভব রসিক মানুষ ছিলেন তিনি। সংসদ ভবনে গম্ভীর তর্ক-বিতর্ক চলাকালীন তাঁর হাস্যরসের স্বাদ নিতেন তৎকালীন মন্ত্রী সাংসদরা। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও তাঁর প্রতি বিশেষ ভাবে অনুরক্ত ছিলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু।
তৎকালীন বম্বেতে থাকাকালীন পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্টতা তৈরি হয়। হরীন্দ্র-কে নিজের অগ্রজ স্থানীয় মনে করতেন হৃষিকেশ। তাঁর পরিচালনায় বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছিলেন হরীন্দ্র। আশীর্বাদ, সাহেব বিবি অউর গুলাম, রাত অউর দিন, তেরে ঘর কে সামনে, চল মুরারী হিরো বননে, বাবুর্চি, গৃহপ্রবেশ-এর মতো হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। গুগাবাবা এবং সোনার কেল্লার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
আফসোসের বিষয় শেষ বয়সে চলৎশক্তিরহিত স্থবিরে পরিণত হয়েছিলেন অসম্ভব জ্ঞানী, নানা রঙের প্রতিভাবন মানুষটি। মুম্বইয়ের কার্টার রোডে নিজের ফ্ল্যাটে শুয়ে আরব সাগরের ঢেউ ভেঙে পড়া দেখেছেন, অপলক চোখে। কথা বলতে পারতেন না, না পারতেন লিখতে। আরও একটি আফসোস থেকে যাচ্ছে, বাঙালির প্রচার বিমুখ এই সিধু জ্যাঠা সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। হয়তো আগ্রহ নেই, বা নেহাতই দুষ্টু জাদুকর বা ১০ মিনিটের সিধু জ্যাঠা হিসাবে জেনেই সন্তুষ্ট থাকতে চেয়েছে।
কেন তার সদুত্তর নেই।