Advertisement

গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব-দুর্বল সংগঠন, বাংলায় BJP-র হাঁড়ির হাল

তপন শিকদার পরবর্তীকালে কেন্দ্রের বাজপেয়ী সরকারের রাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন। এটা খুব স্পষ্ট যে, বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী শুধু যে বাঙালি মুখ ছিলেন না, তা নয়। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির জেলাওয়াড়ি সংগঠনও ছিল না।

শুভেন্দু অধিকারী ও দিলীপ ঘোষ
জয়ন্ত ঘোষাল
  • কলকাতা,
  • 22 Jul 2021,
  • अपडेटेड 6:33 PM IST
  • বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী উত্তরপ্রদেশের বিজেপির রাজ্যপাল হয়েছিলেন
  • দুটো গোষ্ঠীর লড়াই খুব তীব্র হয়ে উঠেছে
  • এই একই যুক্তি দিলীপবাবু অমিত শাহকেও বলেছিলেন

বিজেপির রাজ্য নেতা প্রয়াত বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রীকে অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আডবাণী খুব ভালোবাসতেন। বিষ্ণুকান্তজি, প্রবীণ আরএসএস নেতা জেপি মাথুরের সঙ্গে দিল্লিতে একই ঘরে বসবাস করতেন। তিনি বাংলা ভাষায় বাজপেয়ীজি-র কবিতার অনুবাদ করেছিলেন। বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী উত্তরপ্রদেশের বিজেপির রাজ্যপাল হয়েছিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সংস্কৃতর মাস্টারমশাই ছিলেন।

এহেন বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী বাংলা ভাষায় খুব ভালো বক্তৃতা দিলেও, যেদিন তাঁকে রাজ্য সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে তপন শিকদারকে রাজ্য সভাপতি করা হয়েছিল সেদিন আডবাণীকে প্রশ্ন করেছিলাম— কেন এই বদল?

আডবাণী উত্তরে বলেছিলেন, শাস্ত্রীজি খুব ভালো মানুষ। তিনি পশ্চিমবঙ্গকে বোঝেন না, এমন নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তাঁর পদবী হল শাস্ত্রী। এই শাস্ত্রী পদবী দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির শ্রীবৃদ্ধি হওয়া মুশকিল। তাই তপন শিকদারকে আপাতত রাজ্য সভাপতি করা হল।

তপন শিকদার পরবর্তীকালে কেন্দ্রের বাজপেয়ী সরকারের রাজ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। এটা খুব স্পষ্ট যে, বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী শুধু যে বাঙালি মুখ ছিলেন না, তা নয়। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির জেলাওয়াড়ি সংগঠনও ছিল না। আজ বিজেপি বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে এবং বিধানসভায় ৩ থেকে ৭৭টি আসন লাভ করেছে। এখনও বিজেপির যে সাংগঠনিক শক্তি, তা তৃণমূলের তুলনায় তো বটেই, এমনকী কংগ্রেস-সিপিএম এর তুলনাতেও বহু জায়গায় দুর্বল। শুধু তাই নয়, এতো দুর্বল সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও তাদের দলের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও খুব প্রবল। তার অন্যতম কারণ হল, বিজেপির কর্মীরা, যাঁরা আরএসএস থেকে বা বিজেপির মতাদর্শ থেকে আসা পুরনো লোকজন, তাঁদের যেরকম একটা গোষ্ঠী, আবার শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে তৃণমূল থেকে আসা কর্মী এবং নেতাদের একটা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। মূলত এই দুটো গোষ্ঠীর লড়াই খুব তীব্র হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ বিজেপির মধ্যে এখন কারা আসল বিজেপি, আর কারা মুহাজির বিজেপি— সেইটা নিয়েও কিন্তু একটা মস্ত বড় লড়াই শুরু হয়েছে।

Advertisement

একদিকে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, আর অন্যদিকে শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দু অধিকারী এসেছেন তৃণমূল থেকে, বিজেপিতে যাকে বলা হয়, ‘ল্যাটারাল এন্ট্রি’। এখন এই ‘ল্যাটারাল এন্ট্রি’ হওয়ার মধ্যে আরও একটা সমস্যা হচ্ছে, শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় তৃণমূল থেকে আসা বিজেপির সমস্ত কর্মীরাই যে খুশি, এমন নয়। নিশীথ প্রামাণিক কিংবা সুভাষ সরকার, তাঁরা মন্ত্রী হতে পারেন। তাঁরা নিশীথ প্রামাণিক এবং শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করেই চলছেন, যদিও তিনি সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ-রও প্রিয় পাত্র। আবার অন্যদিকে শান্তনু ঠাকুর, তিনি জাহাজ দফতরের প্রতিমন্ত্রী হয়ে শুভেন্দু অধিকারীর নেক নজরেই আছেন। কিন্তু দিলীপ ঘোষ, যিনি এই দলে দুর্দিনে ছিলেন, যিনি আরএসএস এর বাঙালি মুখ এবং যে দিলীপ ঘোষ প্রচুর পরিশ্রম করে দলকে অনেকটা অগ্রসর করতে সাহায্য করেছেন, তাঁকে রাজ্য সভাপতির পদ থেকে এখনও সরানো হয়নি। এখনও শোনা যাচ্ছে যে, আগামী দিনে হয়তো তাঁকে সরিয়েও দেওয়া হবে। যদিও আরএসএস এর নেতারা কিন্তু দিলীপ ঘোষকে ক্ষমতাচ্যুত করার পক্ষে নন।

এবার যেভাবে মন্ত্রিসভায় রদবদল হয়েছে এবং বাঙালি মন্ত্রীরা ঠাঁই পেয়েছেন, সেখানে দিলীপ ঘোষকে তো মন্ত্রিসভায় আনাই হয়নি, উপরন্তু মন্ত্রিসভায় কারা আসবেন এবং কারা আসবেন না, সে ব্যাপারেও দিলীপ ঘোষের মতামত পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। দিলীপ ঘোষ সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি হিংসাত্মকভাবে কথাবার্তা বলেন এবং যে ধরনের বিবৃতি দিয়ে থাকেন, তাতে তাঁকে সরানোটাই উচিত কাজ হবে। দিলীপ ঘোষ আজ নয়, বহুদিন থেকেই এ ধরনের কথাবার্তা বলেন। একবার মোহন ভাগবত দিলীপ ঘোষকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই ধরনের কথাবার্তা যে তিনি বলেন এবং তাতে যে একটা হিংসার বার্তা থাকে বলে অভিযোগ উঠছে, সে ব্যাপারে ওঁর বক্তব্য কী?

দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন, যেখানে বিজেপির জেলাওয়াড়ি সংগঠন নেই অথচ যাঁরা আছেন, তাঁরা মার খাচ্ছেন, সে অবস্থায় যদি তাঁদেরকে উৎসাহিত করতে হয়, কর্মীদেরকে বিজেপির শিবিরে নিয়ে আসতে হয়, তাহলে একটু ‘গরম গরম’ কথা বলা দরকার। বিবৃতির মাধ্যমে একটু বেশি আস্ফালনে আসলে তো কিছুই করছি না, কিন্তু এই ধরনের কথা বললে একটা ভোকাল টনিক হয়, যাতে কর্মীদের তৃণমূল থেকে বিজেপিতে নিয়ে আসতে সাহায্য করে।

এই একই যুক্তি দিলীপবাবু অমিত শাহকেও বলেছিলেন। সেই ভোকাল টনিকে অনেক কর্মীরা এসেছেন— এটাও যেমন সত্য, আবার তৃণমূল থেকেও শুভেন্দু অধিকারী এসে, যেভাবেই হোক নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ২০০০ ভোটে হলেও পরাস্ত করেছেন। তার ফলে তিনি একজন বিরোধী দলনেতা হয়েছেন। এই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকেই তো আর রাজ্য সভাপতির পদ দিয়ে দেওয়া যায় না! কেননা, তাহলে ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান পোস্ট’ এর ব্যাপার চলে আসবে। সুতরাং, এমন কাউকে রাজ্য সভাপতি করা হোক, যিনি শুভেন্দু অধিকারীর অনুগামী হবেন। এর ফলে যারা তৃণমূল বা বিভিন্ন জায়গা থেকে বিজেপিতে এসেছেন, যাঁদের মধ্যে লকেট চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে মুকুল রায় পর্যন্ত ছিলেন, তাঁরা কিন্তু শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্ব মেনে নিতে পারেননি।

মুকুল রায় তো ইতিমধ্যেই মমতার শিবিরে যোগ দিয়েছেন। এমনকী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবীর ঘোষাল এবং আরও বেশ কিছু বিধায়কও আছেন, যাঁরা ভোটে জিতেছেন, তাঁরাও শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্ব মানতে রাজি নন। শোনা যাচ্ছে, বিজেপির যাঁরা এমএলএ রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে থেকেও কিছু এমএলএ আবার তৃণমূলে চলে আসতে পারেন, যদি তাঁরা ভালো কোনও পুনর্বাসনের সুযোগ পান। এই ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২১শে জুলাই, শহিদ দিবসের বক্তৃতায় তাঁর অবস্থান ব্যক্ত করে বলেছেন যে, তিনি কিন্তু গদ্দারদের ফিরিয়ে আনবার খুব একটা পক্ষে নন। এই পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেটাই এখন দেখার। তবে এটা খুব স্পষ্ট যে, দিলীপ ঘোষ এবং শুভেন্দু অধিকারী— এই দুই নেতা এই মুহূর্তে দুটি ভিন্ন রাস্তায় চলেছেন।

Advertisement

প্রাক্তন বিজেপি সভাপতি তথাগত রায়। তিনি ত্রিপুরা এবং নাগাল্যান্ডে রাজ্যপাল ছিলেন। সেই তথাগত রায়ের বক্তব্যের পাল্লা ভারী শুভেন্দু অধিকারীর দিকে। কারণ, তিনি শুভেন্দুর প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করে, দিলীপ ঘোষকে অপসারণের রাস্তা আরও সুগম করতে ইচ্ছুক। শুভেন্দু অধিকারীর সমর্থন নিয়ে তথাগত রায় রাজ্যের সভাপতি হতেও আগ্রহী। সুতরাং, দিলীপ ঘোষের জায়গায় যদি তথাগত রায়কে রাজ্য সভাপতি করা হয়, তাহলে এ ব্যাপারে শুভেন্দু অধিকারীর কী প্রতিক্রিয়া হবে— সেটাও কিন্তু দেখার। এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে, এই মুহূর্তে বিজেপি হাইকমান্ডের প্রতিনিধি হলেন শুভেন্দু অধিকারী। মোদি এবং অমিত শাহ তাঁকে বেছে নিয়েছেন এবং তাঁকে সামনে রেখেই আগামী পাঁচ বছর তাঁরা লড়াইটা চালিয়ে যাবেন। তার মধ্যে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনও এসে যাবে। তার আগে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন এসে যাবে এবং তারপর পশ্চিমবঙ্গে আবার বিধানসভা নির্বাচন।

দিল্লিতে ‘বিজেপি’ নামক এই দলটি কভার করছি ১৯৮৭ সাল থেকে। এই দলের যত বৃদ্ধি পেয়েছে, ততই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, গোলমালও ক্রমশ বেড়েছে। এখন মোদী এবং অমিত শাহ মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, শুভেন্দু অধিকারীকে সামনে রেখেই তাঁরা এগোবেন। কারণ, একইসঙ্গে তিন-চারজনকে একইরকম গুরুত্ব দিলে বরং গোলমাল বেড়ে যাবে। শুভেন্দু অধিকারী যদি তাঁর নিজগুণে এবং বুদ্ধিমত্তায় দলটাকে সুসংহত করতে পারেন তাহলে তা দলের পক্ষেই হিতকর।

তৃণমূলের নিচুতলার কর্মীরা, যাঁরা বিজেপিতে এসেছেন, তাঁরা বিজেপির যে মতাদর্শ এবং বিজেপির যে ‘স্টাইল অফ ফাংশান’, তার সঙ্গে কিন্তু তাঁদের একটু অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডির সমস্যা হচ্ছে। কারণ, তেলে-জলে মেশানো খুব কঠিন ব্যাপার। এখন এইরকম একটা কঠিন কাজ কিন্তু শুভেন্দু অধিকারীর কাঁধে চেপেছে। দিলীপ ঘোষ এখন লোকসভার সদস্য আছেন কিন্তু তাঁকে মন্ত্রী করা হয়নি। ডিসেম্বর মাসে দিলীপ ঘোষেরও মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তখন তাঁকে সরালে, আগামী দিনে দিলীপ ঘোষের কী ভবিষ্যত হবে, সেটাও খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে এটা খুব স্পষ্ট যে, শুভেন্দু অধিকারীর মনোনীত একজন ব্যক্তিকে রাজ্য সভাপতি করা হবে এবং বিজেপি ক্রমশ সেইদিকেই এগোচ্ছে।

Read more!
Advertisement

RECOMMENDED

Advertisement