কিষেণজিকে মনে আছে? মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও। পশ্চিমবঙ্গে তখন সবে ক্ষমতায় এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১ সাল ২৪ নভেম্বর। হঠাত্ রাতে এল সেই খবর। পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে খতম কিষেণজি। ভারতে মাওবাদীদের মুখ। দশকের পর দশক ধরে মাওবাদীদের নেতৃত্ব দেওয়া সেই কিষেণজি। মাথায় গুলি লেগে ঝাঁঝরা দেহটা মিলেছিল মেদিনীপুরে ঝাড়খণ্ড সীমানায় জঙ্গলে।
কাট টু ২১ মে, ২০২৫
ছত্তীশগড়ে বস্তার এলাকায় গভীর জঙ্গলে এনকাউন্টারে ঝাঁঝরা হয়ে গেল আরও এক মাও নেতা। কিষেণজির পর থেকে ভারতে মাওবাদী সংগঠনের মুখ নাম্বালা কেশব রাও ওরফে বাসবরাজ বা বাসবরাজু। একদা হায়দরাবাদের বাসিন্দা বাসবরাজ দশকের পর দশক ধরে প্রশাসনকে কালঘাম ছুটিয়েছে। ছত্তীশগড়ের নারায়ণপুর জেলার প্রত্যন্ত এলাকা, অরণ্য ও পাহাড়ে ঘেরা অবুঝমাড়ে রোমহর্ষক এক এনকাউন্টারে খতম ৬৮ বছর বয়সি বাসবরাজু সহ ২৭ জন মাওবাদী। নিহত তালিকায় আর উল্লেখযোগ্য নাম, ‘জঙ্গ’ নামক মাওবাদী পত্রিকার পরিচালক নবীন এবং জোনাল কমিটির অন্যতম শীর্ষ নেতা মধু।
এখন প্রশ্ন হল, বাসবরাজ বা বাসবরাজুর মৃত্যু নিয়ে এত শোরগোল কেন?
মাওবাদী নেতা বাসবরাজু নিকেশ কিন্তু সম্প্রতি 'অপারেশন সিঁদুর' সাফল্যের থেকে কোনও অংশে কম নয়। আপনি প্রশ্ন তুলতেই পারেন, পাকিস্তানকে সবক শেখানো অপারেশন সিঁদুরের সঙ্গে বাসবরাজু খতমের তুলনা বাড়াবাড়ি হল না?
না। একেবারেই নয়। বাসবরাজু সহ ২৭ জন মাওবাদীকে খতম করা মানে আক্ষরিক অর্থেই ভারতে মাওবাদীদের নিশ্চিহ্ন করার সামিল। CPI (মাওবাদী) সাধারণ সম্পাদক। দণ্ডকারণ্যে মাওবাদীদের সুপ্রিম নেতা বাসবরাজুকে খতম করা কেন বিশাল সাফল্য, তার প্রমাণ, দশকের পর দশক ধরে তার কুখ্যাত কার্যকলাপ। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, বাসবারাজুকে গ্রেফতার করে বিচারপ্রক্রিয়ায় না এনে খতম কেন করা হল? তাহলে এই প্রশ্নটিও ওঠে, কেন একজন মাওবাদী নেতার মাথার দাম দেড় কোটি টাকা হয়? এই টাকার অঙ্কটিতেই লুকিয়ে রয়েছে, বাসবরাজের নৃশংসতা।
কে ছিল বাসবরাজ?
অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলাম জেলার জিয়ান্নাপেটা গ্রামে জন্ম। পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত কলিঙ্গ সম্প্রদায়। বাসবরাজ ছিল একজন মেধাবী ছাত্র—ওয়ারাঙ্গলের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (তৎকালীন আঞ্চলিক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ) থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। তবে কলেজ জীবনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয় চরমপন্থী ছাত্র সংগঠন 'র্যাডিকাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন'-এর। ১৯৭৯ সালে আরএসএস-এর সঙ্গে এক সংঘর্ষে এক ছাত্রের মৃত্যু হয়। বাসবরাজকে গ্রেফতার করা হয়। পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে সে আত্মগোপনে চলে যায় এবং চিরতরে বেছে নেন ‘গোপন বিপ্লবী জীবন’।
কীভাবে গড়ে তুলেছিলেন মাওবাদী শক্তিকে?
আশির দশকে ‘পিপলস ওয়ার গ্রুপ’-এর হয়ে আন্দামান ও ওড়িশার সীমানাবর্তী আদিবাসী অঞ্চলে কৃষক সংগঠন ও সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে গোষ্ঠীর প্রধান সামরিক কৌশলবিদ। একেবারে গেরিলা যোদ্ধা। ১৯৮৯-৯০ সালের মধ্যে তার পরিকল্পনায় সংগঠনটির সশস্ত্র অভিযান বাড়তে থাকে। সিপিআই (মাওবাদী) তৈরির সময়ও সে ছিল প্রধান সংগঠক ও কৌশলবিদ।
বাসবরাজুর মৃত্যুর প্রভাব কী হতে পারে?
সরকারি সূত্রের দাবি, এই হত্যার ফলে মাওবাদী সংগঠনের নেটওয়ার্কে বড়সড় ভাঙন ধরতে পারে। ইতিমধ্যেই ছত্তীশগড়, গড়চিরোলি-সহ বেশ কিছু জায়গায় মাওবাদীদের আত্মসমর্পণের সম্ভাবনা বাড়ছে। অনেকের মধ্যে আলোচনার ইচ্ছাও দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে, দীর্ঘদিন ধরে মাওবাদীদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত আবুজমারহ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রসদ সরবরাহের পথও এখন নিয়ন্ত্রণে আনতে শুরু করেছে সরকার। ফলে সংগঠন এখন অনেকটাই দিশাহীন।
গত ১৮ মাস ধরে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর লাগাতার অভিযানের ফল বলেই মনে করা হচ্ছে বাসবরাজের মৃত্যু। অনেকের মতে, এটি শুধু এক ব্যক্তির মৃত্যু নয়, বরং ভারতের 'লাল করিডর' পুনর্দখলের প্রক্রিয়ায় একটি বড় সাফল্য।