‘ভাস্কো দা গামা’ এ নামটির সঙ্গে পরিচিত নন এমন মানুষ ভারতীয় উপমহাদেশে খুব একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভাস্কো দা গামা ছিলেন একজন পর্তুগিজ নাবিক, পঞ্চদশ শতাব্দীতে তিনি সমুদ্রপথে ভারতে আসেন। পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আফ্রিকা মহাদেশে এসে পৌঁছান এবং পুরো আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে দক্ষিণ দিক থেকে তিনি ১৪৯৮ সালের ২০ মে তার নৌবহরসহ দক্ষিণ ভারতে কালিকটের কাছে কাপ্পাডুতে পা রাখেন।
ইতিহাসে তিনিই প্ৰথম ইউরোপীয় যিনি সাগর পথ পাড়ি দিয়ে ভারতে এসে উপস্থিত হন। তাঁর এ ভ্ৰমণ এশিয়া ও ইউরোপকে সংযোগ করার পাশাপাশি আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরের মাঝে সেতুবন্ধনের কাজ করেছিল। এ দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে পাশ্চাত্য দুনিয়ার সংযোগ স্থাপনের অন্যতম কারিগর হিসেবে তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। ১৮৬৯ সালে সিনাই উপদ্বীপে সুয়েজ খাল খননের আগে পর্যন্ত নাবিকরা ইউরোপ থেকে এশিয়াতে পৌঁছানোর জন্য তাঁর দেখানো জলপথ অনুসরণ করতেন।
ইতিহাসে ভাস্কো দা গামার এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সে সময় চিন ও ভারত-সহ দূরপ্রাচ্যের দেশের সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্য চলত একমাত্র স্থলপথে। ইউরোপ থেকে এশিয়াতে পৌঁছানোর জন্য মধপ্রাচ্যের দেশগুলোকে সে সময় ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করা হত। কিন্তু সে সব দেশের ক্ষমতাসীন শাসকরা ইউরোপীয় বণিকদের কাছ থেকে শুল্ক আদায় করত। বলাই বাহুল্য সাহেব বণিকরা এই শুল্ক দিতে তেমন একটা আগ্রহী ছিলেন না। তাই সমুদ্রপথ আবিষ্কার করা একান্ত প্রয়োজনীয় ছিল।
এই গির্জায় কবর দেওয়া হয় ভাস্কো দা গামাকে। পাশে তাঁর কবর।
ক্রুসেড আমরা যদিও ধর্ম যুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃতি দিই তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন আদতে ক্রুসেড ছিল ধর্মের অন্তর্জালে সিল্ক রুট-সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ইউরোপীয়দের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা আদায়ের একটি কৌশলমাত্র। ভাস্কো দা গামা ১৪৯৮ সালে যখন প্রথম কালিকটে পা রাখেন তখন কালিকটের রাজা ছিল সামুদিরি। বিদেশি নৌবহর এসেছে শুনে তিনি অত্যন্ত খুশি হন। রাজকীয় সম্মানে ভাল্কো দা গামাকে বরণ করে নেন তিনি।
ভাস্কো দা গামার পক্ষ থেকে রাজা সামুদিরিকে উজ্জ্বল লাল কাপড়ের চারটি জোব্বা, ছয়টি টুপি, চার ধরনের প্রবাল, বারোটি আলমাসার, সাতটি পিতলের পাত্রসহ একটি বাক্স, এক সিন্দুক চিনি, দুই ব্যারেল তেল এবং এক ব্যারেল মধু উপহার দেওয়া হয়। এটা ছিল সমুদ্রকে জলদান করার মতো বিষয়। অত্যন্ত ধনী রাজা সামুদিরির কাছে এ সব উপহারের কোনও মূল্যই ছিল না। তবুও তিনি প্রত্যাখান করেননি। ভাস্কো দা গামা রাজার কাছ থেকে ভারতে ব্যবসায় করার জন্য অনুমতি চাইলেন। রাজা জানালেন, তার অঞ্চলে ব্যবসা করতে হলে অন্যান্য বণিকদের মতো সোনা দিয়ে খাজনা দিতে হবে। রাজার মুখে এ কথা শুনে ভাস্কো দা গামা খুশি হননি। দেশে ফেরার সময় তিনজন নায়েব আর ষোলো জন জেলেকে ধরে নিয়ে যান শুধুমাত্র অত্যাচার করবেন বলে। সমুদ্র যাত্রাপথে এক এক করে নৃশংস ভাবে তাঁদের খুন করা হয়।
১৫০২ সালে পর্তুগাল থেকে ভাস্কো দা গামার নেতৃত্বে চতুর্থ নৌবহর রওনা হয় ভারতের উদ্দেশে। ভাস্কো দা গামা-র ভারতে আসার উদ্দেশ্য ছিল, কালিকটের রাজার উপর প্রতিশোধ নেওয়া এবং পর্তুগিজরা যে শর্ত দেবে সেই মতো আত্মসমর্পণ করানো। রাজার সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায় তিন দিন ধরে লাগাতার গোলাবর্ষণের নির্দেশ দিয়েছিলেন ভাস্কো। রাজা আর উপায়ান্তর না দেখে যুদ্ধ করাই স্থির করেন। কিন্তু গোলাবারুদের জোরে সে যুদ্ধ জেতেন গামা। বেশ কয়েকটি জাহাজ বোঝাই করে ধনসম্পদ, মশলা, বিশেষ করে গোলমরিচ নিয়ে যান পর্তুগালে। সে সময় গোলমরিচকে কালো সোনা বলা হত। ইউরোপে অসম্ভব দামি জিনিস ছিল এই গোলমরিচ।
১৫২৪ সালে ফের একবার ভারতের ফেরেন তিনি। তবে এ যাত্রাই তাঁর শেষ যাত্রা ছিল। যে দেশ থেকে তিনি সব সময় সম্পদ লুঠ করেছেন, মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছেন, সে দেশের মাটি তাঁকে মৃত্যুর পর শেষ আশ্রয় দেয়। আজও কোচিনের গির্জায় তাঁর কবর রয়েছে। যদিও তাঁর দেহাবশেষ ১৫৩৯ সালে ফেরত পাঠানো হয়েছিল পর্তুগালে।
গামার দেখানো পথে এক এক করে স্পেন, ফরাসি এবং সব শেষে ইংরেজ বণিকরা এ দেশে আসতে শুরু করেন। একই ভাবে কলোনি স্থাপনের চেষ্টা করেন এবং বহুলাংশে সাফল্যও পান। ১৭৫৭ সালের পলাশির প্রান্তরে যে ইতিহাস লেখা হল তার ফলে প্রায় ২০০ বছরের পরাধীনতার শিকলে বাঁধা পড়েছিল ভারত। তার বীজও লুকিয়ে ছিল গামার পায়ের নীচে। যে মুহূর্তে তিনি কালীকটে নেমেছিলেন, সে মুহূর্তে সেই বীজ পড়েছিল ভারতের মাটিতে। সেই বীজের ফসলে বণিকের মানদণ্ড, রাজদণ্ডে পরিণত হতে বিশেষ সময় নেয়নি।
কবরের এবং গির্জার ছবি তুলেছেন রজত কর্মকার