তাঁকে বলা হত 'মঞ্চের সুচিত্রা'। বনফুলের লেখা একটি রাত ছবি সুচিত্রা সেন যে চরিত্র পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন, সেই একই চরিত্রে অভিনয় করে বাংলার মঞ্চ মাতিয়ে দিয়েছিলেন বাসবী নন্দী। সেই থেকেই অমন নামকরণ করেন দর্শকরা। আর মঞ্চে কেন, বাংলা ছবির আঙিনায় তাঁর মতো সুন্দরী অভিনেত্রী সে যুগে কমই ছিলেন। গানের গলাও ছিল অসাধারণ। বেশ কয়েকটি ছবিতে তিনি প্লে-ব্যাকেও কণ্ঠ দিয়েছিলেন। এমন বিরল প্রতিভার ৮২তম জন্মদিন আজ।
১৯৩৫ সালে ৫ ডিসেম্বর কলকাতায় জন্ম বাসবী নন্দীর। বাবা বি এল নন্দী ঢাকার একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক ছিলেন। পরে পরিবার নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন তিনি। ইউনাইটেড মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর আশুতোষ কলেজ থেকে আই এ করেন বাসবী। তাঁর বাবার বন্ধু ছিলেন শচীনদেব বর্মন। ছোটবেলায় বাসবীর কণ্ঠে মুগ্ধ হয়েছিলেন 'শচীন কত্তা'। তিনিই ন্ধুকে পরামর্শ দেন যাতে বাসবী গান শেখেন। সেই পরামর্শ মেনেই গানের তালিম দিয়েছিলেন মেয়েকে। একই সঙ্গে মেয়ের নাচের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব তুলে দেন স্বনামধন্য নৃত্যশিল্পী গোবিন্দন কুট্টির হাতে। গানের তালিম পেয়েছিলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায় এবং উৎপলা সেনের কাছ থেকে।
গান-নাচের পাশাপাশি অভিনয়ের প্রতি ভীষণ আগ্রহ ছিল তাঁর। ১৯৫০-এর দশকে মঞ্চ থেকে সিনেমার পর্দায় চলে আসেন বাসবী। ১৯৫৮ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম ছবি যমালয়ে জীবন্ত মানুষ। প্রথম নায়ক ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম সিনেমায় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, তুলসি চক্রবর্তী, ছবি বিশ্বাস, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, পাহাড়ি সান্যাল, কমল মিত্রের মতো বাঘা বাঘা অভিনেতাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্ক্রিন শেয়ার করেছেন বাসবী।
অভিনয় তো চলছিলই, তার সঙ্গে আধুনিক বাংলা গান এবং রবীন্দ্র সঙ্গীতের পথক রেকর্ডও বার হয় বাসবীর কণ্ঠে। বেশ কয়েকটি সিনেমায় প্লে ব্যাকও করেন। কোথাও অনুষ্ঠানে গেলে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া যদিও রজনী পোহাল তবুও গানটি গাওযার অনুরোধ আসতই। কারণ বাসবীর কণ্ঠে গানটি জীবন্ত হয়ে উঠেছে বহুবার। করতালিতে ভরে গিয়েছে অনুষ্ঠানস্থল। কলকাতার সব কটি মঞ্চেই অভিনয় করেন বাসবী নন্দী। স্টার থিয়েটারে ‘কারাগার’ (১৯৬২), রঙমহলে ‘সেইম-সাইড’ (১৯৬৮/৬৯), বিজন থিয়েটারে ‘শ্রীমতী ভয়ঙ্করী’ (১৯৮০) তার উল্লেখযোগ্য নাটক।
মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে অভিনীত বনপলাশীর পদাবলী সিনেমায় অসাধারণ অভিনয় আজও দর্শকদের মনে সজীব রয়েছে। উত্তম কুমারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেন বাসবী। এই ছবির জন্য ১৯৭৪ সালে তিনি বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট’স অ্যাসোসিয়েশন থেকে বেস্ট সাপোর্টিং অ্যাকট্রেসের পুরস্কার পান।
তবে এখানেই তাঁর যাত্রা শেষ নয়। ‘মৃতের মর্ত্যে আগমন’, ‘বাঘিনী’, ‘সেই চোখ’, ‘রাতের কুহেলি’, ‘গজমুক্তা’ ও ‘আমি সে ও সখা’-র মতো অনেক ছবিতে তিনি অভিনয় করেন৷ এছাড়া হিন্দি ছবি ‘দো দিলোঁ কি দাস্তান’ (১৯৬৬)-এও অভিনয় করেন বাসবী নন্দী। এই ছবিতে ছিলেন প্রদীপ কুমার, বৈজন্তীমালা, রেহমান, শশীকলা ও নাসির হোসেন।
এত সফল কেরিয়ার এক লহমায় ছেড়ে বেরিয়ে আসেন একমাত্র সন্তান দেবাঞ্জলী-কে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। প্রায় ২ দশক ক্যামেরা, অনুষ্ঠান, মঞ্চ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন বাসবী। নিতান্ত আড়ালেই সবার অলক্ষ্যে চলে গিয়েছেন ২০১৮ সালে। গভীর রাতে টুপ করে ঝরে পড়া কোনও তারার মতো।