১৯৪৫ সালের ২৩ জানুয়ারি। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনে কলকাতার রাস্তায় বেরিয়েছে প্রভাত ফেরি। নেতাজিকে নিয়ে না শোনা একটি গান গেয়ে এগিয়ে চলেছেন একদল যুবক। গানের কথাগুলি ছিল এরকম –
“সুভাষেরই জন্মদিনে গাইব নতুন গান
সেই সুরেতে জাগবে মানুষ, জাগবে নতুন প্রাণ।”
প্রভাত ফেরির একেবারে সামনের সারিতে থাকা এক যুবক সুরেলা কণ্ঠে বাকিদের সঙ্গে গেয়ে এগিয়ে চলেছেন। তিনিইগানটি লিখেছিলেন এবং সুর করেছিলেন। সেই যুবকের নাম অরুণ চট্টোপাধ্যায়। ভবানীপুর অঞ্চলে সকলেই তাঁকে চেনেন। পরবর্তীকালে গোটা দেশ চিনেছে উত্তম কুমার নামে।
ছোটবেলা থেকেই অভিনয় ভালবাসতেন উত্তম। পারিবারিক নাট্যগোষ্ঠীতে নিয়মিত অভিনয় করতেন। গান ছিল তাঁর ভীষণ প্রিয়। ছোটবেলায় রীতিমতো তালিমও নিয়েছেন। তারপর ধীরে ধীরে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে অবিসংবাদী নায়ক এবং পরবর্তীকালে মহানায়ক হয়ে উঠলেন উত্তম। আজও তাঁর জায়গা শূন্য পড়ে। তা নেওয়ার মতো দ্বিতীয় মহানায়ক আজ অবধি খুঁজে পায়নি বাঙালি। তাঁর মৃত্যুর ৪১ বছর পরেও তাঁর সিনেমা নিয়ে নিরন্তর আলোচনা হয়। তাঁর অভিনয় দক্ষতা, রোম্যান্টিসিজম সব প্রজন্মের কাছে কৌতুহলের বিষয়। কিন্তু অভিনয় এবং গানের পাশাপাশি তাঁর জীবনের আর একটি দিক হয়তো সেভাবে প্রকাশ পায়নি। উত্তম কুমার ছিলেন একজন আদ্যন্ত দেশপ্রেমিক। তিনি স্মৃতিচারণে লিখেছিলেন, ‘আমাদের একমাত্র সহায় তখন নেতাজী। আমরা তখন নতুন আশার বাণীতে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছি।’
ছোট থেকেই যখন তিনি থিয়েটার, নাটক করতেন তখন থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে আত্মপরিচয় দেওয়া। দেশাত্মবোধক গানও লিখতেন তিনি। পাশাপাশি গোপনে যোগযোগ রাখতেন বিপ্লবীদের সঙ্গে। বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘তাইতো’ নাটকটির রিহার্সাল চলাকালীন লিখে ফেলেছিলেন দেশের জন্যে একের পর এক গান। উত্তম বিপ্লবীদের মত বন্দুক-পিস্তল দিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে লড়েননি, কিন্তু অভিনয় করতে করতে বারবার তাঁর মাথায় এসেছে একটাই প্রশ্ন – 'দেশের জন্যে আমি কি করতে পারি?' এ দিকে বাড়ির আর্থিক অবস্থাও খুব ভালো ছিল না। পরিবারের বড় ছেলে উত্তমের উপরই সংসারের ভার এসে পড়েছে। বাধ্য হয়ে এক সময় পোর্ট ট্রাস্টের চাকরিও করতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু দেশের জন্য কিছু করার মানসিকতায় কোনও দিন খামতি ছিল না।
১৯৪৬ সালের গোড়ার দিকে এক দিন উত্তম সোজা চলে গেলেন সতীশচন্দ্র বসুর কাছে। সতীশচন্দ্র বসু ছিলেন বিপ্লবী এবং অনুশীলন সমিতির সদস্য। তাঁকে গিয়ে বললেন, 'আমি আপনাদের জন্যে কি করতে পারি বলুন?' তখন নেতাজির চলো দিল্লি-র স্বপ্ন, সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন বিরাট ধাক্কা খেয়েছে। আই এন এ সৈন্যদের বিচার চলছে দিল্লিতে। মামলার খরচ চালানোর জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন। সতীশচন্দ্র উত্তমকে কিছু আর্থিক সাহায্য করতে বলেন। সে সময় উত্তমের উদ্যোগে লুনার ক্লাবের পক্ষ থেকে একটি চ্যারিটি শো আয়োজন করা হয়। মঞ্চস্থ হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’। সেই শো-এর টিকিট বিক্রি করে ১৭০০ টাকা জোগাড় করেছিলেন উত্তম। ১৯৪৬ সালে এই টাকার মূল্য কম কিছু ছিল না। সেই টাকা সতীশ চন্দ্র বসুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন তিনি।
রুপোলি পর্দার মানুষ হিসাবে তাঁর জীবন নিয়ে কম কাটাছেঁড়া হয়নি। কিন্তু কোথাও যেন উত্তমের এই উজ্জ্বল মানবিক রূপটা নিয়ে আলোচনা বাকি থেকে গিয়েছে।