গঙ্গার পাড়ে হাইকোর্ট। রাজ্য রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে আলোচনার ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই শতাব্দী প্রাচীন লালভবন। আরও ভাল করে বললে, আলোচিত হচ্ছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সাধারণ চাকরি প্রার্থীদের কাছে তিনি মসিহার চেয়ে কোনও অংশে কম নন।নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় তাঁর একের পর এক পর্যবেক্ষণ হিমশীতল রক্ত বইয়ে দিচ্ছে শাসকের শিরদাঁড়ায়। পার্থ-পরেশকে সিবিআই জেরায় পাঠানো থেকে অঙ্কিতার চাকরি বাতিল- জাস্টিস গাঙ্গুলির (Justice Abhijit Ganduly) নির্দেশে খুশি আম আদমি। চাকরিপ্রার্থীদের কাছে তিনি সাক্ষাৎ ঈশ্বরের রূপ। ঘটনা হল, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ই এখন এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের কাছে আশা-ভরসার পীঠস্থান। নেট মাধ্যমে প্রশংসাও কুড়োচ্ছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
২০১৮ সালের ২ মে কলকাতা হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। ২০২০-র ৩০ জুলাই থেকে হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০২১ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের দুর্নীতির অভিযোগের মামলায় একের পর এক নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তার আগে ১০ বছর তিনি আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছিলেন। ন্যাশনাল ইন্সিওরেন্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলাও লড়েছিলেন। তবে গোড়াতেই আইনি পেশায় আসেননি। সরকারি চাকরিতে শুরু তাঁর কর্মজীবন। তবে বেশিদিন সেই চাকরি করেননি। আইন নিয়ে পড়াশুনো করেন। এখন শিক্ষা সংক্রান্ত মামলাগুলির বিচার করছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
শুক্রবার রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতার স্কুল শিক্ষকের চাকরি কেড়ে নিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে ৪১ মাসের টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু এসএসসি মামলা সিবিআই-র হাতে দেওয়াই নয় পরেশ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো দাপুটে মন্ত্রীকেও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়।
শুধু দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলাই নয়, ৭৬ বছরের বৃদ্ধা শিক্ষিকা শ্যামলী ঘোষকে ২৫ বছরের বকেয়া বেতন পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। এজলাসেই কান্নায় ভেঙে পড়েন শ্যামলী দু'হাত তুলে আশীর্বাদ করেছিলেন বিচারপতিকে। আরও আছে। ক্যানসার আক্রান্ত শিক্ষিকার ১২ দিনের বেতন কেটে নেওয়ায় প্রধান শিক্ষকের পদ কেড়ে নিয়েছেন। বকেয়াও দ্রুত সঙ্গে মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্য়ায়। এমন মানবিক বিচারপতি বিরল বলে জানাচ্ছেন এসএসসি চাকরিপ্রার্থীরা। আন্দোলনরত ক্যানসার আক্রান্ত সোমাকে ব্যক্তিগতভাবে ডেকে পাঠিয়ে বিকল্প চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। রাজি হননি সোমা। তিনি চেয়েছিলেন সতীর্থদের সঙ্গে চাকরির নিয়োগ।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে বাগে আনতে তাঁর ঘরের বাইরে ধরনাও দিয়েছিলেন শাসক দলের আইনজীবীরা। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর এজলাস বয়কটের ডাক দেয় কলকাতা হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন। রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় চিঠি লিখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। চাপের মুখেও তিনি বলেছিলেন,'মাথায় বন্দুক ধরে মারতেও পারেন। মরতে রাজি। কিন্তু দুর্নীতি দেখলে চুপ করে থাকব না। আওয়াজ তুলবই।'
তাঁর যুদ্ধে এখানেই থেমে থাকেনি। ডিভিশন বেঞ্চের স্থগিতাদেশের নির্দেশ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দিয়েছিলেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। এমনটা আগে কখনও দেখা যায়নি। আসলে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী নিয়োগের কয়েকটি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের সিঙ্গল বেঞ্চ। একের পর এক মামলায় স্থগিতাদেশ দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। এসএসসি-র তৎকালীন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিংহের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসেব-নিকেশও চেয়েছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। সেই নির্দেশেও ডিভিশন বেঞ্চে স্থগিতাদেশ দেয়।
শুধু যে নির্দেশ দেওয়া তাই নয়। তাঁর একের পর এক পর্যবেক্ষণও 'দাবাং'স্টাইলের। কখনও বলেছেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্ত্রী থাকা উচিত কিনা সেটা খতিয়ে দেখুন মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপাল। কখনও আবার বলছেন, সুযোগ থাকলে গান্ধী পরিবারের সম্পত্তিরও হিসাব চাইবেন। সবমিলিয়ে নায়কোচিত চরিত্র হয়ে উঠেছেন বিচার গঙ্গোপাধ্যায়। স্মরণাতীতকালে কোনও বিচারপতিকে রাজ্যবাসী এক ডাকে চেনে এমনটা কেউ মনে করতে পারছেন না।