বাংলার লোক গানের বৈচিত্র ও ব্যাপ্তি অনেকখানি! বাংলার লোক সংস্কৃতির অন্যতম একটি অংশ হল বোলান গান। আধুনিকতার ধুলো জমতে জমতে যা বর্তমানে প্রায় বিস্মরণ ও অবলুপ্তির পথে। তবে এখনও গাজনের সময় প্রতি বছরই বাংলার গ্রামে-গঞ্জে দেখা মেলে বোলান গান-ওয়ালা শিল্পীদের।
বাংলায় তুর্কি আক্রমণের পর থেকেই (আনুমানিক দ্বাদশ থেকে চতুর্দশ শতকের মধ্যে) বোলান গানের প্রসার ঘটে। বাংলার লোকসংস্কৃতির গবেষকদের একাংশের মতে, তুর্কি তথা সুলতালি আগ্রাসনের হাত থেকে বাংলা লোক সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করেছিল এই বোলান গান। বোলান গান শুধু গান নয়, নাচ-গানে জমাটি সুরেলা গল্পগাঁথা, রঙ্গতামাশা। এর বাঁধন অনেকটা পালাগানের মতোই। বীরভূম, বাঁকুড়া, নদীয়া, মুর্শিদাবাদের মতো জেলার গ্রামে-গঞ্জে নানা পৌরানিক চরিত্রের সাজে, কখনও বা অচেনা বিচিত্র সাজে সেজে ঢোলের তালে তালে নেচে, অভিনয় করে, ছড়া গান গাইতে থাকেন শিল্পীরা।
‘বোলান’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল প্রবচন। তবে বাংলার লোকসংস্কৃতির গবেষকদের একাংশের মতে, ‘বুলা’ বা ভ্রমণ থেকেই বোলান শব্দের উৎপত্তি। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে গাওয়া এই পালা গান তাই ‘বোলান গান’ নামেই পরিচিত। তরজা গানের সঙ্গে এর ফারাক রয়েছে বিস্তর, আবার মিলও রয়েছে। বোলান গানের ক্ষেত্রে শিল্পীরা দলবদ্ধ হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে গানের আসর বসান। দলে একজন গুরু থাকেন। তিনি ঢোলের তালে তালে গান গাইতে থাকেন, বাকিরা সুর মিলিয়ে তালে তালে ধুয়ো তোলেন।
পৌরানিক থেকে সামাজিক নানা কাহিনি গানে গানে তালে তালে ফুটে ওঠে বোলান শিল্পীদের কণ্ঠে। বোলান গানকে মূলত চার প্রকার, দাঁড় বোলান, পালা বোলান, সখী বোলান আর শ্মশান বোলান। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে শিল্পীরা যে গান পরিবেশন করেন, সেটি হল দাঁড় বোলান। নানা গল্প-কাহিনিতে সমৃদ্ধ পর্বকে পালা বোলান বলা হয়। নানা বিচিত্র সাজে মহিলা সেজে শিল্পীরা যে গান পরিবেশন করেন, সেটি হল সখী বোলান। আর মড়ার মাথার খুলি হাতে, প্রেত-পিশাচ সেজে যে আদিরসের ভজনা করেন শিল্পীরা, সেটিকে শ্মশান বোলান বলা হয়।
দ্বাদশ শতকের পর থেকে বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মের নানা পালাবদল, ভয়, দুঃখ, আশঙ্কা, উৎসব, বিশ্বাস ধরা পড়ে এই বোলান গানের প্রচলিত কথায়, সুরে। ঐতিহ্যের বোলান গান পরিবেশনকারী শিল্পির সংখ্যা এখন হাতে-গোণা। মুষ্টিমেয় কিছু দরিদ্র শিল্পীর উৎকৃষ্ট পরিবেশনে আজও বেঁচে আছে ঐতিহ্যের বোলান গান, ফিরে আসে গাজনের টানে!