ঝরঝরে বাংলা ও ইংরেজিতে কথা বলেন। ভাইরোলজিতে ডক্টরেট। স্বভাবতই আচার-আচরণে শিক্ষার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু এইসবের সঙ্গে তার চেহারা, তার জীবন-যাপন বড্ড বেমানান। শীর্ণকায় চেহারা, পরনে অপরিচ্ছন্ন পোশাক, উস্কোখুস্কো ধূসর চুল। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ডানলপ মোড়ের আশেপাশে অনেকেই তাকে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন। কখনও চায়ের দোকান, কখনও বা রাস্তার পাশে খাবারের দোকানের সামনে। ফুটপাতেই রাত কাটান। ফলে মাঝেমধ্যে দোকানদাররা বিরক্ত হন। পথচলতি মানুষও তাকে এড়িয়ে চলেন। তবে ফুটপাতবাসী হলেও তিনি ভিক্ষুক নন। পরিচয়ের দিক থেকে তিনি যে কোন ভিআইপি-কেই চমকে দিতে পারেন। তিনি ইরা বসু। তার দাবি তিনি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শালিকা অর্থাৎ মীরা ভট্টাচার্যের বোন।
জেলারই খড়দহ প্রিয়নাথ গার্লস হাই স্কুলের জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষিকা ছিলেন ইরা দেবী। ভাইরোলজিতে পিএইচডি করেছেন তিনি। স্কুলের সহকর্মীদেরও অনেকেই তার সাথে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আত্মীয়তার কথা জানতেন। যদিও ইরাদেবী নিজে কখনও তার ভিআইপি পরিচয়ের বিষয়টি জাহির করতেন না। জানা গিয়েছে, ২০০৯ সালের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ওই স্কুলে শিক্ষকতা করেন ইরাদেবী। একটা সময় তিনি থাকতেন বরানগরের দাদুর বাড়িতে।সেখান থেকে ইরাদেবী চলে আসেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা কৃষ্ণকলি চন্দের খড়দহের লিচু বাগানের বাড়িতে। পরে সেখান থেকেও আচমকা উধাও হয়ে যান তিনি। প্রধান শিক্ষিকা জানান "ওই স্কুলে পড়াতেন ইলা বসু অবসর নেওয়ার পর তার পেনশন যাতে ঠিকঠাক হয় তার জন্য চেষ্টা করেছিলেন প্রধান শিক্ষিকা। কিন্তু তার অভিযোগ পেনশন সংক্রান্ত নথি জমা দেননি ইরা দেবী, ফলে পেনশন চালু হয়নি।
কিন্তু একজন শিক্ষিকা হয়েও তাকে কেন ফুটপাতে জীবনযাপন কাটাতে হয়েছিল? এ ব্যাপারে ইরাদেবীর সহকর্মীরা জানিয়েছেন অনেকবারই পড়ুয়ারা, শিক্ষক সংগঠনের সদস্যরা মিলে তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ইরা ফেরেননি। কারও থেকে সাহায্য নেওয়া তো দূর অস্ত! এক কাপ চাও নিজের পয়সাতেই কিনে খান। তিনি স্পষ্ট জানান "আমি নিজের খাবারের খরচ নিজেই চালাই। রাস্তার ভিখারি নই।" তিনি এও জানান 'জামাইবাবু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হলেও তার থেকেও কোনও সুবিধা তিনি নেননি।
খড়দহের এক ব্যবসায়ী রবি দাস জানান শিক্ষক দিবসে তিনি চিকেন বিরিয়ানি, মটন খাইয়েছেন। ডানলপ ট্রাফিক গার্ড রাজীব রায় জানান "তিনি পয়সা চাননি, বরং নিজের পয়সাতেই তিনি খাওয়া-দাওয়া করেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবসের দিন ডানলপ মোড়ে এই প্রাক্তন শিক্ষিকাকে সংবর্ধনা জানায় আর্তজনের সদস্যরা। তাকে উত্তরীয় পরিয়ে, মিষ্টিমুখও করানো হয়। সে সময় ইরা বসু জানান "আমি প্রিয়নাথ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলাম। আমি ১৯৭৬ সালে ওই স্কুলে জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করি। তখন ওই স্কুল মাধ্যমিক ছিল পরে সেটি উচ্চমাধ্যমিক হয়। স্কুলের শিক্ষকরা আমাকে অসম্ভব ভালোবাসে এখনো যারা আসে তারা জড়িয়ে ধরে আমাকে কাঁদে। আমি ভাইরোলজি ডক্টরেট করেছিলাম। আমার সময় ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন নলিনী দেব। অন্য স্কুলে সুযোগ পেলেও আমি কোথাও যাইনি। আমি এই স্কুলে থেকে গিয়েছিলাম এবং ৩৪ বছর শিক্ষকতা করেছি।"
২৮ শে জানুয়ারি দিনটি তার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ ওই দিনে তিনি শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসর নেন। দিনটাকে স্মরনীয় করে রাখতে সেদিন নিজের সাধ্যমত ৬০ জনের বেশি বাচ্চাকে রুপোর চামচ, বই, পেন্সিল উপহার দিয়েছিলেন। তবে কেবল শিক্ষাই নয়, খেলাধুলাতেও যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য ভিত্তিক একটি প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার রানে তিনি প্রথম হয়েছিলেন বলে জানান ইরাবতী। এর পাশাপাশি টেবিল টেনিস, ক্রিকেট ময়দানে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। যদিও বয়সের ভারে এখন অনেকটাই নুব্জ হয়ে পড়েছেন।
ইরা দেবী জানান, আমি এখন উত্তরবঙ্গে থাকি। সেখানে আমার আত্মীয়-স্বজন আছে। এছাড়া সল্টলেকেও তার একটি বাড়ি রয়েছে। বুদ্ধদেববাবুর প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বলেন "আমার কিছুটা সমস্যা হচ্ছে, কারণ একজন বিশাল রাজনীতিবিদদের আত্মীয় আমি। যদিও আমি তাকে কোনওদিন বিরক্ত করিনি। ১৯৭৬ সালে আমি যখন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করি তখন আমার নিজের যোগ্যতায় করি। বুদ্ধদেববাবুর কোনও সহায়তা আমি নিইনি। আমি তার পরিচয় দিতে চাই না। যদিও অনেকেই আমার এই পরিচয় জেনে গিয়েছে।"
করোনাকালে বর্তমানে স্কুলগুলিতে যেভাবে অনলাইন ক্লাসে শিক্ষাদান করা হচ্ছে তা নিয়ে ঘোর আপত্তি রয়েছে ইরা দেবীর। তিনি জানান অনলাইনে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা কোন মতেই মেনে নিতে পারছিনা। অনলাইনে কখনো পড়া হয়না এই ব্যবস্থায় যারা পড়াশোনা করছে তারা প্যাকটিকালে কিছু শিখলো না।" মিডিয়ার দৌলতে বিষয়টি সামনে আসতেই তৎপর হয় প্রশাসন। খড়দা পৌরসভার পক্ষ থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় বরানগর থানায়। সেখানে আম্বুল্যান্স এর মধ্যেই তার প্রাথমিক চিকিৎসা করা হয়। এরপর প্রশাসনের উদ্যোগে তাকে কলকাতার একটি মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আপাতত সেখানেই ভর্তি আছেন ইরা বসু।