অ্যাম্বুল্যান্স দাদার শপথ
অসুস্থ মাকে রাতে হাসপাতালে সময়মতো নিয়ে যেতে পারেননি। ফলে বাঁচাতেও পারেননি। সেই শোকে শপথ নিয়েছিলেন, মায়ের মত মুমূর্ষু রোগী, যাঁরা রাত বিরেতে যখনি তাকে ডাকবে তিনি ছুটে যাবেন তাঁদের শুশ্রূষায়। প্রথমে মায়ের শোক ভুলতে এ পথে নামলেও ক্রমশ নিজের কমিটমেন্টে নিজেই জড়িয়ে পড়েছিলেন।
বাইকই হয়ে ওঠে অ্যাম্বুল্যান্স
ক্রমশ নিজের দু চাকার মোটরবাইকই হয়ে ওঠে তাঁর অ্যাম্বুল্যান্স। এলাকার চার পাঁচটি গ্রামের বিপদের বন্ধু হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমশ বিভিন্ন জায়গায় প্রচার হয়ে যাওয়ার পর তাঁকে নিয়ে চর্চা পৌঁছয় দিল্লী পর্যন্ত। যার ফল, তিনি স্বীকৃতি পান নিঃস্বার্থ সেবার জন্য। দেশের অন্যকম অসামরিক পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করা হয় তাঁকে। তাঁকে নিয়ে তৈরি হয় তথ্যচিত্র।
তবু লক্ষ্য়ে অবিচল করিমূল
তারপর থেকেই জীবনের মোড় ঘুরে যেতে পারত করিমুল এর। তাঁকে নিয়ে বলিউডে তৈরি হচ্ছে বায়োপিক। তার নিজের জায়গায় তিনি তৈরি করছেন হাসপাতাল। তার জন্য তৈরি হয়েছে ফান্ড রেইজিং কমিটিও। ইতিমধ্যেই পরিকাঠামোর প্রাথমিক কাজ হয়ে গিয়েছে। আংশিক চালুও হয়েছে হাসপাতাল। তবু তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন এখনও। আগের মতোই।
করিমূল বিভ্রান্ত হননি
তাঁর মতো পরিস্থিতিতে পড়লে অনেকেই পুরস্কার, লাইম লাইট, ফ্ল্যাশ বাল্বের ঝলকানির পর এক্সিকিউটিভ হয়ে যান। নিজের অধীনে লোক খাটানো শুরু করেন। কিন্তু তিনি তো করিমূল। তিনি তো নিজের গা থেকে মাটির গন্ধ মুছে ফেলতে চাননি। তাই হাজার প্রতিপত্তি, বৈভব, আলোর রোশনাই-এর মধ্যেও নিজের পুরনো বাড়িতেই পুরনো পদ্ধতি মেনেই এখনও এলাকার মানুষের বিপদের সঙ্গী হয়ে, মুশকিল-আসান হয়ে দেখা দিচ্ছেন।
সঙ্গী সেই বাইক অ্যাম্বুল্যান্স
সঙ্গী তাঁর সেই বাইক অ্যাম্বুল্যান্স। আগে ছিল শুধুই বাইক। একটি বাইক প্রস্তুতকারী সংস্থা তাঁকে একটি বাইক অ্যাম্বুল্যান্স উপহার দিয়েছিল। বিশেষভাবে তাঁর জন্য তৈরি করে বাইকের সঙ্গে লাগানো ট্রেলারে খোলা শোয়ার ব্যবস্থা। ব্যাস আর কি চাই জীবনে! এর চেয়ে ভালো উপহার বোধহয় আর পাননি জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার মহকুমার ক্রান্তি-রাজাডাঙ্গা এলাকার করিমূল হক।
সরকারি ব্যবস্থার আগে তাঁকেই ফোন করেন মানুষ
এলাকার স্বাস্থ্য পরিষেবা আগের চেয়ে অনেক উন্নত। তিরিশ বছর আগে যেমন ছিল তেমন তো নেইই। তবু এলাকার মানুষ স্বাস্থ্য পরিষেবার চেয়ে করিমূলের আশ্বাসেই বেশি বিশ্বাস করেন। করোনা পরিস্থিতিতেও তার অন্যথা হচ্ছে না। বিপদে পড়লে রাত-বিরেতে এখনও প্রথম ফোন আসে করিমূল কিংবা তাঁর বড় ছেলে আচানুলের কাছেই।
করিমূলের দাবি
করিমুলবাবু জানালেন, এই কাজ করেই পরিচিতি পেয়েছি। পরিচিতি টা বড় কথা নয়। মানুষের পাশে থাকব ভেবেছিলাম, সেই কাজ আজীবন করে যেতে চাই। তবে হ্যাঁ পরিস্থিতি বিচার করে সুরক্ষা বজায় রাখতে হচ্ছে। পিপিই কিট পড়ে, করোনা বিধি মেনেই কাজ চলছে। এ কাজে তাঁর সহায়ক এখন বড় ছেলে আচানুল।
করোনায় অক্লান্ত অ্যাম্বুল্যান্স দাদা
শুধু রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছনো কিংবা বাড়িতে নিয়ে আসা নয়, এলাকায় বাড়ি বাড়ি স্যানিটাইজ করার কাজ করছেন তিনি। রোগীর জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ছুটছেন মাঝরাতে। পাশাপাশি সচেতনতা প্রচার, মনোবল বাড়ানোর ক্ষেত্রে এগিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স দাদা। তাঁর তৈরি হাসপাতাল খুলে দেওয়া হয়েছে করোনা রোগীদের সেবায়। সেখানেও কিছু শয্যা তৈরি করে চলছে প্রাথমিক চিকিৎসা। হাসপাতালে চিকিৎসক রয়েছেন। তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন করিমূল।
রোগীর পরিবারের পাশেও অক্লান্ত পদ্মশ্রীপ্রাপক
পাশাপাশি করোনা রোগীদের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। এক সঙ্গে এত দায়িত্ব কীভাবে পালন করেন? এ কাজই আমার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। যতটা নিজে পারি, করি। নইলে বড় ছেলে সাহায্য করে। দুজনের মিলিত কাজের বাইরে গ্রামের অনেকেই আমাদের সাহায্য করেন। পাশাপাশি প্রশাসনিক সহায়তায় চাইলেই। আর কী চাই! আজীবন এভাবেই অ্যাম্বুল্যান্স দাদা হিসেবেই থাকতে চাই।