চোরাকুঠুরিতে ভেজাল মদের কারখানা
বিলাসবহুল বাড়ি। বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরে মাটির নিচে চোরাকুঠুরি। দিব্যি তাতে দিনের পর দিন তৈরি হচ্ছিল ভেজাল মদ। বিশেষ করে বিহারে মদ নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে মদের কারবার জমে উঠেছিল তৃণমূল নেতার বাড়িতে। ধৃত অভিযুক্তকে জেরা করতেই কোটি কোটি টাকার কারবার ফাঁস।
পুরনো ফিল্মের সেটের মতো ঘর
সাত-আটের দশকে বলিউডি মশালা ফিল্মের চিত্রনাট্যের মতো সাজানো বাড়ি। ঘরের মধ্যে ঘর। তার মধ্যে ঘর। কোন ঘরে কে বা কি থাকে, তার কোনও হদিশ নেই। প্রতিটি ঘরে একাধিক সিসিটিভি। একটি ঘরের নীচে দিয়ে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে চোরাকুঠুরিতে। সেখানেই ভেজাল মদের কারখানা। তৃণমূল নেতার বাড়িতে হানা দিয়ে চোখ কপালে পুলিশর।
পুলিশ সেটিংয়ে চলছিল কারবার, অভিযোগ
শিলিগুড়ি মহকুমার ফাঁসিদেওয়া থানা এলাকার বিধাননগর এলাকায় ওই প্রাক্তন তৃণমূল নেতা বিশ্বজিৎ সরকারে বাড়িতে হানা দিয়ে পুলিশ মদের ঠেক সিল করে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই জাল মদের রমরমা চললেও স্থানীয় পুলিশ এবং প্রশাসনকে 'সেটিং' করেই চলছিল বেআইনি ব্যবসা। শাসকদলের প্রাক্তন সভাপতি হওয়ায় গত ১০-১১ বছরে কেউ তার টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। অন্যদিকে পুলিশের প্রত্যক্ষ মদতেই কারবার চলছিল বলে স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ। বিহার পুলিশ খবর পেতেই, মুখ রক্ষার তাগিদে শেষমেষ বিহার পুলিশকে সহযোগিতা করতে হয়েছে ফাঁসিদেওয়া থানা পুলিশকে। নইলে এ চক্রে হাত দিত না পুলিশ। অভিযোগ বিজেপিরও।
বাড়ি থেক পাঁচশো মিটারে বিধাননগর পুলিশ ফাঁড়ি
বিধাননগরে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতার বাড়ি থেকে ৫০০ মিটার দূরে ফাঁসিদেওয়া থানার অধীন বিধাননগর ইনভেস্টিগেশন সেন্টার। তৃণমূলের প্রাক্তন অঞ্চল সভাপতি বিশ্বজিৎ সরকারের বাড়ির এত কাছে হওয়া সত্ত্বেও কোনওদিন পুলিশ নাকি জানতেই পারেনি। তার বাড়িতে শনিবার অভিযান চালায় বিহার ও স্থানীয় পুলিশের যৌথ দল। অভিযোগ, বিহার সীমান্ত কাছে হওয়ায় এখান থেকে জাল মদ তৈরি করে গোটাটাই বিহারে পাচার করতো বিশ্বজিৎ। যেহেতু বিহারে মদ বিক্রি ও মজুত করা অপরাধ এবং নিষিদ্ধ তাই সেই সুযোগে কম দামে বিহারে পাচার করে মোটা টাকা মুনাফা লাভের ছক কষেছিল।
প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার কাঁচা মাল উদ্ধার
ফাঁসিদেওয়া ব্লকের বিধাননগর সহোদরগছ এলাকায় বিলাসবহুল বাড়ি বিশ্বজিৎবাবুর। বাড়িতে হানা দিয়ে ভিতরে কারখানা থেকে ২শো লিটার স্পিরিট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ৯০টি ড্রামে ওই মদ ভরা ছিল। ২৪টি কাচের বোতল, ৩০ টি কার্টন, একটি প্লাস্টিক জার ছাড়া ৫০ টি খালি ড্রাম বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। অভিযুক্তের বাড়ির সামনের পাহারা বসানো হয়েছে। পুলিশের তরফে ধারণা একেকটি স্পিরিট বোঝাই ড্রামের মূল্য প্রায় ৫০ হাজার টাকা। উদ্ধার হওয়া স্পিরিট এর মোট বাজারমূল্য প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা বলে পুলিশের ধারণা।
অনেকেই জানতেন, ভয়ে চুপ ছিলেন
তবে পুলিশ কিছু জানেন না বলে দাবি করলেও স্থানীয় বাসিন্দার জানতেন বলে স্বীকার করেছেন। কেউই তৃণমূলের দোর্ণ্ডদপ্রতাপদের ভয়ে মুখ খোলেননি। অনেকেই জানেন বিষয়টি বলে জানা গিয়েছে। বাড়ির ভিতর একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। এছাড়া বাড়িতে প্রচুর ঘর। পণ্যবাহী গাড়ি দুটি, যাত্রীবাহী ছোট গাড়ি রয়েছে। এছাড়াও একটি শববাহী গাড়ি রয়েছে।
বিহারের ভেজাল মদের কারিগররা কাজ করতেন
ওই বিশাল বাড়ির ভিতর আন্ডারগ্রাউন্ড ঘর রয়েছে। যেখানে মদ তৈরিতে দক্ষ বিহারের কর্মীদের কাজে লাগিয়ে তৈরি হতো জল মদ। স্থানীয় বাজারে খুব একটা সে মদ বিক্রি হয় না। বেশির ভাগটাই বিহারে পাচার করে দেওয়া হতো বলে স্থানীয় পুলিশের অনেকদিন পর্যন্ত র্যাডারে আসেনি। সত্তর-আশির বলিউডি সিনেমার মতো কুঠুরির ভিতর কুঠুরি তৈরি করা হয়েছে।
কোনওদিন বিশ্বজিতের মদের ট্রাক ধরা পড়েনি
স্থানীয়দের একটা অংশের অভিযোগ পুলিশের অনেকেই বিষয়টি জানত এবং পাকা মাসোহারা বাঁধা ছিল। তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা অনেকেই বিষয়টি জানত। বিজেপির তরফ এ বিষয়টি নিয়ে তৃণমূল এবং পুলিশের যোগসাজশের অভিযোগ তোলা হয়েছে। দার্জিলিং জেলা পুলিশের রুরাল শাখার কোনও পদক্ষেপ করেনি। প্রতিদিনই শিলিগুড়ি ও লাগোয়া এলাকা থেকে বেআইনি মদ, ভেজাল মদ বাজেয়াতপ্ত হয়। কিন্তু গাড়িতে করে পুলিশ ফাঁড়ির নাকের ডগা দিয়ে দিনের পর দিন মদ পাচার হয়ে গেলেও বিশ্বজিৎবাবুর ভেজাল মদের ট্রাক কোনওদিনও ধরা পড়েনি। কেন? উত্তরের অপেক্ষা রাখে না।