কোথাও শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মী কেউই নেই, বন্ধের মুখে স্কুল। কোথাও আবার হেডমাস্টারকেই ঘণ্টা দিতে হচ্ছে। কোনও স্কুলে পরীক্ষা নেওয়ার জন্য কেউ নেই। আদালতের রায়ে চাকরিহারাদের নিয়ে সমস্যায় পড়েছে উত্তরবঙ্গের একের পর স্কুল। মালদা থেকে দিনাজপুর, কোচবিহার থেকে জলপাইগুড়ি।
শুক্রবার দিনভর তালা বন্ধ ছিল অফিস। চাকরি বাতিলের জেরে স্কুলের একমাত্র অশিক্ষক কর্মীই আর নেই। তাই এমনই ছবি ধরা পড়ল দক্ষিণ দিনাজপুরের কুমারগঞ্জ ব্লকের আঙিনা-বরইট হাইস্কুলে। কুমারগঞ্জ ব্লকে মোট ৩০ জন শিক্ষক ও ১৩ জন অশিক্ষক কর্মচারীর চাকরি গিয়েছে। একইভাবে, পতিরাম থানার পাঁচটি পঞ্চায়েত এলাকায় চাকরি হারিয়েছেন ২৪ জন, যার মধ্যে ৫ জন অশিক্ষক কর্মচারী। কিছু স্কুলের অবস্থা খুবই খারাপ। আঙিনা-বরইট হাইস্কুলে আজ অফিস ঘরে তালা পড়ে, কারণ সেখানে কোনও অশিক্ষক কর্মী অবশিষ্ট নেই। চারজন শিক্ষক ও দুইজন নন-টিচিং স্টাফের চাকরি বাতিল হওয়ায় স্কুল অচল হয়ে পড়েছে। ডাঙ্গারহাট, সাফানগর, দিওর পানাউল্লা, রাইখন-মঞ্জুরিচক, বালুপাড়া গার্লস, গোলাবাড়ি ও এলেন্দারি হাইস্কুলেও একই পরিস্থিতি। একাদশ-দ্বাদশ স্তরের ক্লাস কার্যত বন্ধ হওয়ার জোগাড়।
সমস্যা দেখা দিয়েছে পরীক্ষা সংক্রান্ত খাতা নিয়ে। অনেক শিক্ষক এখনও উচ্চ মাধ্যমিক, একাদশ এমনকি মাধ্যমিক পরীক্ষার খাতাও নিজের হেফাজতে রেখেছেন। এই খাতা কীভাবে ফেরত আনা হবে, তা নিয়ে প্রশাসনের মাথাব্যথা বেড়েছে।চরম সংকটে মালদার গাজোল ব্লকের বহু স্কুল। কোনও স্কুলে এমন অবস্থা যে ঘণ্টা বাজানোর কাজ করতে হচ্ছে প্রধান শিক্ষককে। বাদনাগরা হাইস্কুলে ৭০০ ছাত্রছাত্রীর স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ১৮ জন। তার মধ্যে চাকরি বাতিল হয়েছে পাঁচজনের। দুইজন শিক্ষাকর্মী, তাদেরও চাকরি যাওয়ায় বর্তমানে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব কাজই করতে হচ্ছে প্রধান শিক্ষককে। এমনকি ঘন্টাও বাজাতে হচ্ছে তাঁকেই।
খুবই খারাপ অবস্থা গারাধুল হাইস্কুলেরও। ১৪ জন শিক্ষক-শিক্ষিকার মধ্যে চাকরি বাতিল হয়েছে ৬ জনের। এদের মধ্যে অংক এবং ইংরেজির দুইজন করে শিক্ষক রয়েছেন। ভূগোল এবং সংস্কৃত বিভাগের রয়েছেন একজন করে শিক্ষক। এছাড়াও খোঁজ খবর নিয়ে জানা গিয়েছে চাকরি বাতিল হয়েছে গাজোল হাইস্কুলের ৪ জন শিক্ষক, একজন শিক্ষাকর্মীর, শিউ চাঁদ পরমেশ্বরী বিদ্যামন্দিরের তিনজন শিক্ষক, ময়না হাইস্কুলের ৬ জন শিক্ষক, রানিগঞ্জ কৃষ্ণচন্দ্র হাইস্কুলের ৫ জন শিক্ষক, আলাল হাইস্কুলের ৩ জন শিক্ষক এবং একজন শিক্ষাকর্মী, বাবুপুর হাইস্কুলের দুইজন শিক্ষক এবং একজন শিক্ষাকর্মী, তরিকুল্লা সরকার হাইস্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের দুই জন শিক্ষকের চাকরি বাতিল হয়েছে। বৈরডাঙ্গি হাইস্কুলের ৬ জন শিক্ষকের চাকরি বাতিল হয়েছে। চাকরি বাতিল হয়েছে চাকনগর হাইস্কুলের ৫ জন শিক্ষক এবং দুইজন গ্রুপ ডি কর্মীর। সব মিলিয়ে এবার প্রায় প্রতিটি স্কুলই শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীর সংকটে ভুগতে চলেছে।
গাজোল ব্লকে সবথেকে বেশি চাকরি হারিয়েছেন শ্যামসুখী বালিকা শিক্ষা নিকেতনে্র শিক্ষিকারা। এই বিদ্যালয়ে ১৫ জন শিক্ষিকার চাকরি বাতিল হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন শিক্ষিকা বিশেষভাবে সক্ষমও রয়েছেন। এরই সঙ্গে চাকরি বাতিল হয়েছে দু’জন শিক্ষাকর্মীর। মোট ৫৯ জন শিক্ষিকার মধ্যে ১৫ জনের চাকরি বাতিল হওয়ায় বর্তমানে স্কুলে শিক্ষিকার সংখ্যা ৪৪। আচমকা এতজন শিক্ষিকা কমে যাওয়ায় ফাঁপরে পড়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
বৃহস্পতিবার সুপ্রিম রায়ের জেরে বড়সড়ো প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে এবছরের উচ্চমাধ্যমিকের খাতা দেখা এবং ফলাফল প্রকাশ। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে শেষ হওয়া চলতি বছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার খাতা দেখার কাজ চলছে জোরকদমে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এদিন চাকরি হারানো শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেশিরভাগের কাছেই রয়েছে উচ্চমাধ্যমিকের খাতা। এদিন চাকরি বাতিলের নির্দেশের পর সেই খাতার ভবিষ্যৎ নিয়েও উঠছে বড় প্রশ্ন।
মালদার রতুয়া-১ ব্লকের একমাত্র বালিকা বিদ্যালয় সামসী (Samsi) সীতাদেবী বালিকা বিদ্যামন্দির। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের (Supreme Court) রায়ে এই স্কুলের ৪ জন শিক্ষিকা ও দু’জন শিক্ষাকর্মী চাকরি হারিয়েছেন। একসঙ্গে এতজনের চাকরি বাতিল হওয়ায় বিপাকে স্কুলের পঠন-পাঠন। অন্যদিকে, ওই ব্লকের ভাদো বিএসবি হাইস্কুলের মোট ছয়জন শিক্ষকের চাকরি বাতিল হয়েছে। তারমধ্যে তিনজন বিজ্ঞান বিভাগের, একজন ইংরেজি ও দু’জন সোস্যাল সায়েন্সের।
মালদা জেলায় চাকরি হারালেন ১৩৫৮ জন। এরমধ্যে রয়েছেন কয়েকজন শিক্ষাকর্মীও। একইভাবে উত্তর দিনাজপুরে চাকরি হারিয়েছেন ৭৪০ জন শিক্ষক ও ৯২ জন শিক্ষাকর্মী। দক্ষিণ দিনাজপুরে চাকরি হারালেন ৫১১ জন শিক্ষক ও ৭০ জন শিক্ষাকর্মী। মোট সংখ্যাটা দঁাড়াল ২৭৭১।
রায়গঞ্জ সহ জেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে এদিন করুণ চিত্র ধরা পড়েছে। বাতিলের তালিকায় নাম রয়েছে ডালখোলা উচ্চবিদ্যালয়ের ৬ জন শিক্ষক ও ডালখোলা গার্লস হাইস্কুলের ৬ জন সহ ১ ক্লার্কের। অন্যদিকে, এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ফরাক্কার আমতলা উচ্চবিদ্যালয়ের ১৭ জন, অর্জুনপুরের ৩৭ জন, ইমামনগর হাইস্কুলের ৪ জন , ব্রাহ্মণগ্রাম বালিকা বিদ্যালয়ের ৫ জন, তিলডাঙ্গা ও নিশিন্দা স্কুলের ৭ জন করে শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন। এছাড়াও ধর্মডাঙ্গা উচ্চবিদ্যালয়ের ১১ জন, বাহাদুরপুরের ৫ জন চাকরি হারিয়েছেন। এপ্রসঙ্গে ইমামনগর স্কুলের শিক্ষক সৌমিত্র মিশ্রের মতে, ‘সুপ্রিম কোর্টের এই রায় দুটো বিষয়ের সামনে এসেছে, যা কি না অস্থিরতা তৈরি করেছে। বহু স্কুল শিক্ষকের অভাবে কীভাবে চলবে বোঝা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, যাঁরা সংসার পরিজন নিয়ে বাস করছেন কিংবা ঋণ নিয়ে বাড়িঘর তৈরি করেছেন, তাঁরা এখন সর্বস্বান্ত এবং দিকভ্রান্ত।’
আদালতে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর শিক্ষকতার কাজে যোগদানের অধিকার পেয়েছিলেন শিলিগুড়ির বাসিন্দা অনামিকা রায়। কলকাতা হাইকোর্টের (Calcutta High Court) নির্দেশে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাজগঞ্জের হরিহর উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ২০২৫-এর এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্টের (Supreme Court) নির্দেশে সেই চাকরিজীবনে ইতি পড়ল।
বালুরঘাট গার্লস হাইস্কুলে (Balurghat Girls High School) চাকরি হারিয়েছেন ১১ জন। এর মধ্যে ১০ জনই শিক্ষিকা এবং একজন শিক্ষাকর্মী রয়েছেন। ১০ জনের মধ্যে ইংরেজি, অর্থনীতি, ভূগোল, ফিলোসফি, অংক, কম্পিউটার, লিটারেচার এবং সায়েন্সের শিক্ষিকা রয়েছেন। জানা গিয়েছে, গতকাল চাকরি চলে যাওয়ার পর এদিন তাঁরা কেউ স্কুলে আসেননি। এদিকে প্রত্যেক স্কুলে বর্তমানে পরীক্ষা চলছে। যার ফলে পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক সমস্যায় পড়তে হয় স্কুল কর্তৃপক্ষকে। বহু স্কুলে বিএড প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের পরীক্ষাকেন্দ্রে গার্ড হিসেবে রাখা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
যে সমস্ত স্কুলে এসএসসি ২০১৬ সালের প্যানেলে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ হয়েছে, অসুবিধায় পড়েছে সেই স্কুলগুলি। এমনিতেই বিভিন্ন স্কুলে রয়েছে শিক্ষকের অপ্রতুলতা। এবার এই রায়ের ফলে, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের অভাব পড়তে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে।