রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রের সংঘাত যে কেবল নির্বাচনী আবহেই সপ্তমে ওঠে তা নয়, বছরভর তরজা জারি থাকে যুযুধান সব পক্ষের মধ্যে। দেশের, রাজ্যের বিভিন্ন ইস্যুতে শাসক-বিরোধী সমীকরণ অবশ্য এমনটাই থাকে। কিন্তু সব ছাপিয়ে বঙ্গ রাজনীতিতে এ বছর বাগযুদ্ধে শিরোনামে ছিল নরেন্দ্র মোদী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংঘাত। বছরের শুরুতে করোনা হানা, লকডাউন, আমফান, কেন্দ্রীয় সাহায্য, আর্থিক প্যাকেজ, পরিযায়ী শ্রমিক, কোভিড ভ্যাকসিন, ২০২০ সাল যেন পুরোটাই তরজা বছর। এক নজরে ফিরে দেখা মোদী-মমতার বাগসংঘাত।
প্রসঙ্গ করোনা-লকডাউন-আর্থিক প্যাকেজ
করোনার দাপটে বদলে গিয়েছে গোটা দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমি। প্রধানমন্ত্রী মোদীর লকডাউন ঘোষণা ও করোনার সংক্রমণ নিয়েও জারি ছিল সংঘাত। তা সে নাইসেডে করোনা পরীক্ষা হোক, কিংবা করোনা রিপোর্ট, লকডাউন বিধি নবান্ন-দিল্লি পত্রযুদ্ধও বহাল ছিল। কেন্দ্রের নিশানায় ছিলেন মমতাই।
লকডাউন বিধি খতিয়ে দেখতে রাজ্যে আসে কেন্দ্রীয় দলও। তাদের রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যে যে চিঠি পাঠানো হয়েছিল সেখানে বলা হয়, "রাজ্যে করোনায় মৃত্যুর হার ১৩.২ শতাংশ। যে কোনও রাজ্যের তুলনায় বেশি। নজরদারি ও চিহ্নিতকরণের অভাব স্পষ্ট।’
তবে পাল্টা তোপ দাগেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কেন্দ্র ও মোদী প্রসঙ্গ টেনে সাফ জানিয়ে দেন, ”একদিকে বলছে লকডাউনে শক্ত হতে হবে, যাতে কেউ বেরোতে না পারে। আবার বলছে, সব দোকান খুলে দাও। কেন্দ্র যা বলছে আর যা নির্দেশ দিয়েছে, তার মধ্যে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে, বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে আমরা ৩ ঘণ্টা বোবার মতো শুনেছি। কারও কিছু বলার ছিল না। আমাদের বলতে দেয়নি।" লকডাউনের মধ্যে রাজ্যের বকেয়া টাকা নিয়ে মোদীকে চিঠিও লেখেন মমতা। মোদীর অবশ্য মত সঠিক ভাবে করোনা পরীক্ষা হচ্ছিল না বাংলায়।
লকডাউনের মধ্যে কেন্দ্রের আর্থিক প্যাকেজ নিয়েও সরব হন মমতা। আত্মনির্ভর ভারত গড়ার ডাক দিয়ে ২০ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেন নরেন্দ্র মোদী। যদিও মমতার মত, কেন্দ্রের ২০ লক্ষ কোটির আর্থিক প্যাকেজ আসলে ‘অশ্বডিম্ব’। মোদীকে লক্ষ্য করেই মমতার মত, "এই দুর্দিনেও মানুষকে ধোঁকা, ভাঁওতা দিয়েছে। কর্মসংস্থানের কথা নেই। কিছু দেওয়া হয়নি। করোনা মোকাবিলায় কিছুই দেওয়া হল না। গোটাটাই বিগ জিরো। ভেবেছিলাম হয়তো রাজ্যগুলো কিছু পাবে। কিছু নেই। অশ্ব ডিম্ব”।
প্রসঙ্গ আমফান
সুপার সাইক্লোন আমফানে তছনছ হয়েছিল দক্ষিণবঙ্গ। মমতার অনুরোধের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আমফান বিধ্বস্ত বাংলা পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রী জানান, ”আমরা একদিকে অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াই করছি, আবার ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যয় হয়েছে…আমরা চাই বাংলা এগিয়ে চলুক। কেন্দ্র বরাবর পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে রয়েছে। এই পরিস্থিতি ছাড়া বাংলা ভালভাবে লড়াই করছে। এই কঠিন সময়ে আমরা বাংলার পাশে রয়েছি”। হাজার কোটির অর্থ সাহায্যও ঘোষণা করা হয়।
যদিও আমফান ত্রাণের অর্থ নিয়ে এবার বড় রকমের চাপানউতোর শুরু হয়ে গিয়েছে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য জানিয়েছিলেন, “আমফানের ক্ষতিপূরণ তাড়াতাড়ি দিতে গিয়ে কিছু ভুল হয়েছিল। তা ০.৫ শতাংশ।"
প্রসঙ্গ রেশন
লকডাউনে রাজ্যবাসীর মুখে অন্ন জোগাতে কেন্দ্র-রাজ্য রাজনীতিও চলেছে জোরকদমে। প্রাথমিকভাবে সেপ্টেম্বর অবধি কেন্দ্রের রেশন দেওয়ার কথা থাকলেও নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান মোদী। এ কথা জানার পরেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আগামী বছরের জুন মাস পর্যন্ত বিনামূল্যে রেশন দিতে থাকবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। শুধু তাই নয়, কেন্দ্র যে চাল দিচ্ছে বা দেবে, তার চেয়ে রাজ্য সরকারের দেওয়া চালের মান উন্নত বলেও এ দিন দাবি করেন তিনি। মোদী সরকারের দেওয়া রেশন নিয়ে অভিযোগ তুলে মমতা জানান, "যে রেশনটা ওঁরা দিচ্ছেন, সেটা ৬০ শতাংশ লোক পাচ্ছেন, ৪০ শতাংশ লোক পাচ্ছেন না। আমাদের চালটা ভাল চাল, ওঁদের চালের মানটা খারাপ।"
প্রসঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক-রেল
লকডাউনের ফলে ভিন রাজ্যে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিক ইস্যু নিয়েও বজায় ছিল মুখ্যমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী ঠান্ডা লড়াই। রেলের সঙ্গেও বিরোধ বাঁধে মমতার। রাজ্যে করোনার রাশ টানতে ভিন রাজ্যে থেকে ট্রেনে করে শ্রমিক আনতে নারাজ ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। যা নিয়ে কেন্দ্রীয় তোপের মুখেও পড়তে হয় তাঁকে। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগের সুরে জানান, "মানুষকে যখন বাঁচাতে চাইছি (কোভিড-আমপান-পরিযায়ী পরিস্থিতিতে), তখন কেউ কেউ বলে বেড়াচ্ছে, বাংলা আমরা দখল করব। দখল তো অনেক করেছ। কত রাজ্য তোমাদের অধীনে। আর কী দরকার? প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে প্রচুর টাকা জমা পড়েছে।"
এদিকে, পরিযায়ী শ্রমিকদের কল্যাণে কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী গরিবকল্যাণ রোজগার অভিযান প্রকল্পে নাম রাখা হয়নি বাংলার। সম্প্রতি মমতা বলেন, "পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেনের ভাড়াও দেয়নি কেন্দ্র। পরিযায়ীদের ফেরাতে বাস-ট্রেনের ব্যবস্থা করেছি। বিজেপি তখন কোথায় ছিলে?"
প্রসঙ্গ কোভিড ভ্যাকসিন
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কার্যকর ভ্যাকসিন কবে মিলতে পারে তা নিয়ে প্রাথমিকভাবে কিছু জানাননি মোদী। ভ্যাকসিন আবিষ্কার আমাদের হাতে নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সুরক্ষার দিক বিবেচনা করেই ছাড়পত্র দেওয়া হবে এমনটাই মত প্রধানমন্ত্রী। এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। বৈঠক শেষেই তাঁর বক্তব্য, "‘কোভিডের বিনা পয়সার চিকিৎসাও করতে দেবে না! নাটক করে। শুধু মিথ্যা ভাষণ দেয়, অফিসারদের চমকায়। বাংলার বদনাম করে। ভাষণ দিতেই ব্যস্ত রয়েছেন। অনেক বড় বড় কথা বলছে। কিন্তু, কেউই জানেন না কবে করোনার ভ্যাকসিন আসবে।