
২০২২ সাল। নদিয়া। নৃশংসতার দুঃস্মৃতি আজও তাড়না করে হাঁসখালির বাসিন্দাদের। নাবালিকার গণধর্ষণ, খুন।তারপর প্রমাণ লোপাটের চেষ্টায় জোর করে শ্মশানে দাহ। শুধু হাঁসখালি নয়। তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য। তিন বছর পর সেই মামলায় বড় রায়। সোমবার নয় জন অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করল রানাঘাটের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালত (এডিজে)। মঙ্গলবার সাজা ঘোষণা। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে এই ঘটনার তদন্তভার ছিল সিবিআইয়ের হাতে।
আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, এই মামলায় মূল অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ব্রজগোপাল গোয়ালি ওরফে সোহেল গোয়ালি এবং তার বাবা, TMC নেতা সমরেন্দ্র গোয়ালিকে। আদালতের পর্যবেক্ষণ, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র থেকে শুরু করে সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট, ভয় দেখানো এবং নাবালিকার গণধর্ষণের মতো একাধিক গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত অভিযুক্তরা।
আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, সোহেল গোয়ালি, প্রভাকর পোদ্দার ও রঞ্জিত মল্লিকের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০বি (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র), ৩৪ (যৌথ অপরাধ), ২০১ (প্রমাণ লোপাট), ৫০৬ (ভয় দেখানো), ৩০৪(২) এবং ৩৭৬ডিএ ধারায় দোষ প্রমাণিত হয়েছে। পাশাপাশি, পকসো আইনের ৬ নম্বর ধারাতেও তারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। সুরজিৎ রায় ও আকাশ বাড়ৈয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও ভয় দেখানোর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। সমরেন্দ্র গোয়ালি, দীপ্ত গোয়ালি ও পীযূষ কান্তি ভক্তকে প্রমাণ লোপাট ও ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। অংশুমান বাগচীর বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র ও প্রমাণ লোপাটের অভিযোগে দোষ প্রমাণিত হয়েছে।
২০২২ সালের সেই ঘটনা শিউরে ওঠার মতো। অভিযোগ ছিল, এক কিশোরীকে জন্মদিনের পার্টির নামে ডেকে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করা হয়। দীর্ঘক্ষণ নির্যাতনের পর রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে বাড়ির সামনে ফেলে যাওয়া হয়। রাতভর রক্তক্ষরণের পর মৃত্যু হয় কিশোরীর। অভিযোগ, মৃত্যুর পর কোনও ময়নাতদন্ত ছাড়াই তড়িঘড়ি দেহ দাহ করা হয়।মৃত্যুর শংসাপত্র ছাড়াই। পরিবারের সদস্যদের ভয় দেখিয়ে গোটা বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছিল বলে সিবিআই তদন্তে উঠে আসে।
যদিও অভিযুক্তরা প্রথমে সমস্তটাই অস্বীকার করেছিল। তাদের দাবি ছিল, ঘটনার দিন বিকেলেই বাড়ি রওনা দেয় কিশোরী। অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত এগিয়েও দিয়ে আসে ব্রজগোপাল গোয়ালি। এরপর বাকিটা তারা জানে না বলে দাবি করে। পাশাপাশি মেয়ের দেহ মা, বাবা কেন এত তড়িঘড়ি, ময়নাতদন্ত ছাড়া দাহ করলেন, সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন অভিযুক্তরা।
এই ঘটনায় রাজনৈতিক বিতর্কও কম হয়নি। সমরেন্দ্র গোয়ালি স্থানীয় তৃণমূল নেতা ছিল। ফলে অভিযোগের তীর ঘুরে যায় শাসকদলের দিকেও। তদন্তের শুরুতে নানা প্রশ্ন উঠলেও, শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্তে নামে এবং চার্জশিট পেশ করে।
রায় ঘোষণার পর ফের প্রশ্ন উঠছে, ন্যায়বিচার পেতে এতটা সময় লাগল কেন? তবে একই সঙ্গে একাংশের মত, এই রায় অন্তত এটা প্রমাণ করল যে, কেউ যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, অপরাধ করলে সেও আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আপাতত মঙ্গলবার সাজা ঘোষণার দিকেই তাকিয়ে গোটা রাজ্য।